স্বপ্নের শরীরে গেঁথে থাকা মায়াবী রক্তের দাগ : রক্তিম ভট্টাচার্য

ধীমান ব্রহ্মচারীর “শহর ও কবিয়াল” – স্বপ্নের শরীরে গেঁথে থাকা মায়াবী রক্তের দাগ

ধীমান ব্রহ্মচারীর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “শহর ও কবিয়াল” নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বইটির নামকরণে নজর দেওয়া প্রয়োজন। “শহর” এবং “কবিয়াল”- আপাতদৃষ্টিতে দুই ভিন্ন সমাজের পরিচায়ক। “শহর”-এর মধ্যে স্বপ্ন আছে, বিশালত্ব আছে, ইচ্ছাপূরণের সম্ভাবনা আছে। আর, “কবিয়াল” শব্দে সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার চোখ আছে, বিশালত্বকে অনুমান করার ক্ষমতা আছে, আর যে ইচ্ছাপূরণের সম্ভাবনার কথা আগের বাক্যেই বলা হল, সেই ইচ্ছাটা হওয়ার মতো একটা গভীর, অনুভবী বোধ আছে। কবিয়াল এক ঐতিহ্যের স্পন্দন, সে তার কথা-কথকতায় ডুব দিতে চায় সরল, সাদামাঠা, সাহজিক অবগাহনে, আর শহর তাকে নিয়ে আসে মহানগরের গোলকধাঁধায় অস্তিত্বকে ক্রমনিরীক্ষমান পর্যবেক্ষণে রেখে, মেজে-ঘষে শানিয়ে নেওয়ানোর জন্য। এই ক্ষীণতনু কবিতার বইটি কবির তথা কবিয়াল-কথকের আত্মচরিতের এক সঘন যাপনের খতিয়ান।
বইটির ভূমিকায় বিশিষ্ট চিন্তক, কবি মঞ্জুভাষ মিত্র যথার্থই বলেছেন, “’শহর ও কবিয়াল’ কাব্যগ্রন্থে কবির আত্মজীবনী, তার অন্তরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে। এখানে রয়েছে দুই সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব”। এই কবিয়ালের জীবন গড়ে ওঠে গ্রামে। একটা আপাত-সহজ, নান্দনিক, প্রাকৃতিক ছন্দে উদ্দীপ্ত জীবনের রেশ। কবিয়াল এই জীবনকে বাঁচে প্রতি মুহূর্তে, চিনে নেয় মাটি, জেনে নেয় ঘাম-রক্তের উষ্ণ গন্ধ। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। গাছ যত বড় হয়, মাটির বুকে গেঁথে থাকা শিকড়ের ক্ষত তত দগদগে হয়ে ওঠে। কবিয়াল শহরে আসে। বিরাট নগরের আলো-আঁধারিতে এক গ্রাম্য, অনভিজ্ঞ, অপটু জীবনদর্শন রুগ্নের মতো দিশেহারা হয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ, জান্তব সভ্যতার মানচিত্রে। কবি লেখেন, “শহরের ওপর শহর তার ওপর শহর / বিচিত্র শহরের আনাচে কানাচে জমে আছে সংসার / ভিটেহীন, ঘরহীন মানুষের শহর” (‘শহরেরা’)।
এই শহরে কবিয়ালের ইতিহাস নতুন নয়। কিন্তু তাঁদের কবিতায়, গানে, কথায় শহরের খেদের কথা কতখানি স্পষ্ট, আলোচকের ক্ষুদ্র-জ্ঞানে অজানাই। কিন্তু এই উদ্বাস্তু কবিয়ালের তরুণ শরীরে জন্ম নেয় লড়াই, সে গান বাঁধে স্বপ্নের চোখে চোখ রেখে, সে ছায়া আঁকড়ে ধরে ধাবমান হয় আলোর উৎসের দিকে। তাই কবিয়ালের কথায় এক শূন্যতাবাদী জীবনের আঁচড় স্পষ্ট। “শূন্যতায় ভাসবে আমাদের মানবসত্তা / শহর আগলে রাখবে আমাদের মৃতদেহ” (‘এখনও সময়’)। দৈনিক আঘাতের প্রতিলিপি জমে থাকে নাগরিক যন্ত্রণার নতুন ভিক্টিমের কাছে। কবি লিখছেন, “অনেক দিনের পেরিয়ে আসা স্মৃতিটুকুই দেখি / দু-জনের চোখ দিয়ে / এখন আর গোধূলি দেখি না / দেখি অন্ধকারের খেলা” (‘অস্তরাগ’)। এক দীর্ণ কষ্টের, ক্লেদের অভিমান পুষে রাখা মনে চাগাড় দেয় সমাজের ক্ষয়। কবি লেখেন, অন্ধকারে জমে থাকা কালো ইতিহাসের কথা- “ক্লান্ত পায়ে জড়িয়ে ধরেছে ঘুম / ফুটপাত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে উনুন আঁচে। / রাতের আহার শেষে ধোয়া হাতের জল / গড়িয়ে পড়ে / ম্যানহলের গর্তে / শহর গহ্বরে লুকিয়ে থাকে / আদিম পৃথিবীর পাপ” (‘আদিম পাপ’)।
আসলে কবির নতুন করে কিছু বলার নেই। নতুন করে কিছু চেনানোর নেই। তিনি দেখছেন, সময়ের অবক্ষয় আর নাগরিক অভিশাপের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে গেছে শহর। আসলে, গোটা বইটা যেন কবিতা। বারবার, বারংবার, একই ছবি, একই চিত্রকল্প কবি লিখে রাখেন। টি এস এলিয়ট তাঁর কবিতায় যেভাবে এক আধুনিক যুগের ক্ষয়কে লিখে রাখেন চ্যুত-সন্দর্ভের প্রকরণে (sense of alienation), এই বইয়ে কবিও ইচ্ছাকৃতভাবেই এই টেকনিকের আশ্রয় নিয়েছেন। কিছু বাছাইকৃত পঙক্তি একত্রিত করলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে-
“তবুও পূর্ণিমার ঝলসানো রুটিটাকে তুমি / অবাক হয়ে দেখো / … / হয়তো রয়েছে হুতোম প্যাঁচাও… / চারিদিকে ধর্ষণ, আগুন জ্বলছে” (‘অরকুট’)
“শহর থিতিয়ে পড়ে রয়েছে রক্তাক্ত রাস্তার ওপর / … / তখন বুঝতে পারি আমরা যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি…” (‘বিলীন’)
“শুধু স্থবির হয়ে মানছি হট্টগোল / রক্ত লাশ দেখছি প্রতি ভোরে রোডের ধারে,…” (‘বারুদ’)
“কালো মেঘ শহরটাকে ঘিরে ধরেছে নিজের মতো করে, যেভাবে হায়না শিকার করে শিকারকে…” (‘লুকোচুরি’)
“এ শহরের বুকে আছে ইতিহাসের সাদাকালো রং / শীতের রাতে নিঃশব্দে পাহারা দেয় / ফুট জুড়ে থাকা তীব্র চিৎকার” (‘শহরের এক শীতকালীন রাতে’)
“সভ্যতার লাশ মাড়িয়ে চলছে আমার সত্তা / … / রক্তের গন্ধ আসে নাকে, / আমরা রুমাল চাপা দিই, দুর্গন্ধের জন্য…” (‘একটি রাজনৈতিক আচরণ’)
কিন্তু এই কবিয়ালের চোখে চোখ রাখতে পারার ক্ষমতা আছে। শূন্যতা থাকলেও তাতে নিস্তরঙ্গ, নিঃস্পৃহ উদাসীনতা থাকবে না, থাকবে প্রতিবাদের ঝাঁঝ। তিনি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন, আগাম প্রস্তুতি নেন যুদ্ধের। লিখে রাখেন আঘাত, রুক্ষ প্রতিশ্রুতি জমিয়ে রাখেন গভীরে। তিনি লেখেন- “এখনও ইতিহাস আমাদের জীবনের শিক্ষা দেয় / প্রতিদিন ক্ষয় হতে হতে সমাজের মূর্ততা তুলে রাখি / আত্মমগ্নতায়” (‘এক থাকার গান’)। এই কবিতারই শেষে গিয়ে কবি লেখেন অন্তিম সংবেদ, “অস্থি মজ্জায় জমে থাকা আঘাত ক্ষয় হয়ে মিলিয়ে যায়, আমাদেরই চেতনায়”। ‘এখানে মানুষ লড়াই করে জীবন দিয়ে’ কবিতায় বাস্তববেত্তা কবি জীবনদর্শনের কথা লেখেন নৈর্ব্যক্তিক চলনে, “কত উদাসীন চোখ দেখে বিভেদহীন সমাজের স্বপ্ন / কত রক্ত দেখে শোষকদের চোখ / তবুও লড়াই চলে”। ‘বারুদ-২’ শীর্ষক কবিতায় সঙ্গোপনে খোদিত করেন কবি তাঁর দিনগত অভিপ্রায়, “হিসেব ছিল সাহসী চোখের, / … / শহরের কোনো এক কোণে নিঃশব্দে আততায়ী রেখে যেত বারুদ”। এই কবিতার প্রেল্যুড ‘বারুদ’ কবিতায় কবি লিখছেন সেই প্রতিবাদী ধ্বনির সূচক।
“আমরাও পারি পালটা মার, আর কত চলবে
মাফিয়ারাজ মাফিয়ারাজ
রাতের অন্ধকারে আমরাও দেব হানা
আমরাও মুখোমুখি দাঁড়াব শাসকের
স্তিমিত আলোর রোশনায় মহলে
মাফিয়ারাজ মাফিয়ারাজ
আমাদেরও দুহাতে থাকবে এই মৃত্যু দেশের ঝান্ডা আর
লোডেড পিস্তল।“
শৈশবের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি, প্রেম, দোটানার কথাও কবিতার উপজীব্য। পারিবারিক ভুলের ইতিহাস, ক্ষণজন্মা মিলনের অন্তর্লীন শোক-বিরহ, সন্তাপের কথামালায় জারিত হয় শহরের রাস্তা। নির্বিকার কবিয়াল জানেন না, কোনওকিছুই আর ঠিক হবে কি না। তিনি বাবার মৃত্যুর ছবি আঁকেন নির্বাক ঔদাসীন্যে।
“বাবার প্রেসার আরও নেমে যাচ্ছে। আরও নামছে।
সারা রাত ধরে নেমেই গেল…
শেষে আর ওঠানো গেল না।“
(‘১৩ই আষাঢ়, ১৩২১)
তবু, শহর যে এক বিরাট স্বপ্নের কুঠুরি, এও তিনি অবচেতনে লালিত করেন। তাই প্রগতির চক্রে ছিন্নভিন্ন হয়েও কবি এঁকে নেন বসন্তের স্বর্গীয় আশ্বাস। ‘বসন্ত কবিতায় এই বিপ্রতীপ বিভাজিত চিত্রকল্পই লিখে রাখেন কবি।
“চেয়ে দেখি সব শুনশান,
শুধু একটা শিমুল গাছ,
পরনের জামা প্যানটাও আজ নেই,
গত বসন্ত কেড়ে নিয়েছে ওর সব।
এ বসন্তের অপেক্ষায় ও পথ চেয়ে।
নতুনটাকে গায়ে মেখে নিতে চায় ও।
আমি শহুরে খবরের কাগজটা ওলটাই
আর চায়ে অনায়াসে
চুমুক দিয়ে দেখি শুঁয়োটাকে,
শেষ ডালে পৌঁছে গেছে।
বিপদ কেটে গেছে দু-জনেরই।
এবার বসন্ত নিয়ে আসবে ওদের প্রেমকে।“
কবিতায়, কথায়, ইতিবৃত্তে, পুনরাবৃত্তে, শহুরে মেজাজি ঢং-এর পরিচিত কল্পকে ক্রম-প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে, রাজনৈতিক বল্গাহীনতা ও মেরুদণ্ডের শৈল্পিক ছককে অস্বস্তিতে ফেলে, স্মৃতি-বিভ্রম-ইতিহাসের পর্যাবৃত্ত গতিকে সুদূরপ্রসারী মায়ালীন যাপনে ছেঁকে বিক্ষুব্ধ প্রতিস্পর্ধী কবিয়াল তাঁর পথ নির্মাণ করেন। সে-রাস্তায় আধুনিক খেদ, সে-রাস্তায় মৌলিক বিপদ। তবু, তিনি স্থিরতায় অবিশ্বাসী। তাঁর স্থবিরতায় মগ্ন প্রস্তুতি সারে ইতিবাচক সন্ত্রাসের অভিশ্রুতি। মেরুকরণের অসীম বৈপরীত্যে দাঁড়িয়ে এই বানভাসি কবিয়াল লিখে চলেন শহুরে স্বপ্নের সারাৎসার, যা তাঁকে কোনও একদিন ঠিকই সম্পৃক্ত করে নেবে সভ্যতার অলীক ক্ষরণে।
“কথা হোক মানুষের ভিড়ে আজন্মকাল”।
=========================================================

গ্রন্থঃ শহর ও কবিয়াল
গ্রন্থকারঃ ধীমান ব্রহ্মচারী
প্রচ্ছদঃ দেবরাজ জানা (চিত্র), সুপ্রসন্ন কুণ্ডু (নামাঙ্কন)
প্রকাশনাঃ এবং অধ্যায়
মূল্যঃ ১৫০ টাকা মাত্র (মুদ্রিত)

ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply