মীরার গান : একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া

রক্তাক্ত পৃথিবীর মধ‍্যে বাস করে রক্তের সঙ্গে ব‍্যক্তিগত সাক্ষাৎকার অনিবার্য হয়েই থাকে‌। তবু কথা বলে যেতে হয়। শব্দ নাকি ‘ব্রহ্ম’ সাক্ষাৎ। আর ‘ব্রহ্ম’ সাক্ষাৎ ‘নেতি’। শব্দ তবে ‘নেতি’? কিছুটা হয়তো সত‍্যি। স্ট্রাকচারাল লিঙ্গুইসটিকসের তত্ত্ব বলে সাইন language এর দুই প্রধান অংশ সিগনিফায়ার এবং সিগনিফায়েড সবসময় artibrary সম্বন্ধে থাকে। অর্থাৎ দেরিদার ‘Signifier always defers’ ধরলেও সেই কথাতেই আসতে হয়। যেকোনো শব্দের অর্থের ধনাত্মক তৈরী হয় একগাদা নেতি জড়ো করে। তাই ব্রহ্মস্বরূপ শব্দ নিয়ে যে ভাঙতে বসে, সে জানে নেতির উপাসনা কি। ব্রহ্ম উপাসনা কি। সভ‍্যতার উপাসনা করতে কোন ব্রাহ্মমূহুর্ত দরকার। তাত্ত্বিক প্রসঙ্গে আসতাম না। কিন্তু কেন এলাম তার কারণ আছে। কথাগুলো লিখতে বসেছি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বইএর সমালোচনা করতে। কাজেই আমি জানি অত পোষাকি আলোচনার এক্ষেত্রে প্রয়োজন ও নেই। কিন্তু নেতির প্রসঙ্গে তবু এলাম। কারণ নেতিস্বরূপিণী ভাষা যখন আত্মজ্ঞান পেতে নতজানু হয়, তখন আহরিত ব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান ছাপিয়ে নিজেকে অন‍্য উপকূলে তুলে আনে। বলা ভালো আবিষ্কার করে। এই বই এর প্রতি অধ‍্যায় গুরুতর অভিজ্ঞতার বয়ান। যাদের মধ‍্যে অধিকাংশ রক্তক্ষয়ী। কিন্তু শব্দের ধর্মই। তা আবরণ ভাঙতে জানে। আবরণ পরতেও জানে। এই খোলা পরাতেই নিজের রাজনৈতিকতা স্থাপন করে।
বইটা পড়তে পড়তে বারবার হেলেন সিসোর কথা মনে পড়েছে। আর কিছুর জন‍্য নয়। সিসো একটা কথা বলেছিলেন। নারী দেহ জন্মাবধি উদ্বাস্তুতার  অভিজ্ঞতা শরীরে বহন করে। এই উদ্বাস্তুতার জন‍্য কোনো কাঁটাতার পেরোতে লাগে না। একধরনের আধুনিকতা প্রতিনিয়ত মেয়েদের শরীরে, মনে যে আত্মছিন্নতার অনুভব করায়, সেটুকুই পর্যাপ্ত। তাই শব্দের বকলমা দরকার। জটিলতর বর্ম প্রয়োজন, যা ধারণ করতে পারে সেই আত্মঘাতী আত্মকথনকে। যা সিসিফাসের মতো দগ্ধ হতে হতে পৃথিবীতে পথ হাঁটায়। অথচ মৃত‍্যু দেয় না। ‘মীরার গান’ তেমনভাবে কথা বলে। জগতের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে একা একা। বইটার ক্ষমতা এটাই যে পাঠককে জড়ো করতে পারে। বলতে পারে সময়ের প্রস্থচ্ছেদ করে মেয়েরা নেমে এসো। হস্তিনাপুরের রাজসভা থেকে হাথরাস হয়ে মথুরা, কলাপোতা, নিশ্চিন্দিপুর, কিংবা দ্বারকার সমুদ্রতট। নেমে এসো বিক্ষত জনমানবী। সবাই কথা বলো। আজ আমরা সকলে একপাত্রে পরমান্ন খাব। আমরা সবাই একপাত্রে বিষপান করব। কারণ আমরা ভগিনী। আমাদের ছন্দের অধিকার আছে, ভাষার অধিকার আছে, স্বপ্নের অধিকার আছে, স্বপ্নভঙ্গের অধিকার আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা ভাবনার অধিকার আছে। আক্ষরিক আচারে বই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তারপর ও ইন্দ্রপ্রস্থের সম্রাজ্ঞী সভামধ‍্যে আঁচলের প্রান্ত গায়ে তোলেন, ডোপডী মেঝেন ক্ষতবিক্ষত স্তনে ধার দেন, একতারা হাতে মীরা পথে নামেন, ইন্দুবালা শিল পেতে মানকচু বাটতে বসেন। রাক্ষসী ‘তাড়কা’ ঈশ্বরের তিরবিদ্ধ মোক্ষতে থুতু ছিটিয়ে কাটা স্তনের রক্তে অযোধ‍্যাকে অশুদ্ধ করে যান। এই অশুদ্ধি বড়ো ধ‍্যানের বস্তু। তাকে জয় করতে হয় যাপন দিয়ে। ‘মীরার গান’ সেই বিজয়কে খোঁজে। কিছুটা স্বপ্ন দিয়ে, স্বপ্নভঙ্গ দিয়ে, বাকিটা স্বপ্ন দেখবার অধিকার দিয়ে। একদিন নিশ্চয়ই নিশ্চিন্দিপুরের মাঠে ঠিক দুর্গা আর আসিফা দুজনে দুজনের হাত ধরে ট্রেন  দেখতে যাবে।

মীরার গান
লেখক- রাজসী বসু কুণ্ডু
প্রকাশনা- ইতিকথা পাবলিকেশন
প্রচ্ছদ- সৌরিন দাস
মূল্য- ১০০/-

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By সঞ্চারী দীর্ঘাঙ্গী

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ থেকে স্নাতক হয়েছেন, এখন চলচ্চিত্রবিদ‍্যায় স্নাতকোত্তর করছেন। অ্যাকাডেমিক নিবন্ধ লেখার পাশাপাশি কবিতা, গদ‍্য আর পেইন্টিং এ নতুন ভাষা খোঁজার চেষ্টা করছেন।

Leave a Reply