বুননের কথা, ওপড়ানোর কথা

বইটার নাম “ফারাক“, প্রচ্ছদে অক্ষরগুলো যথেষ্ট দূরত্বে রয়েছে, যেন ফারাক কথাখানার বিস্তার বিশাল! এই কথাটাই এক এবং একমাত্র সত্য।

কবি বইয়ের শুরুতেই একথা স্বীকার করেছেন যে ঠিক বাস্তবের আকার আকৃতির মধ্যে আঁটছে না এই কবিতাগুলো। কবির চলাচল নিজেরই ভেতরে, আরও ভেতরের দিকে ঢুকে গিয়ে নিজের অস্তিত্বের সময়টুকু খুঁজে বের করা, এবং সম্ভবপর হ’লে সেটাকে তুলে ধরা।

এই বইটির প্রথম কবিতা “মানুষ”; তীব্র দহন তীব্র শ্লেষের উৎপত্তি ঘটিয়েছে। দগ্ধে দিয়েছে কবিকে অন্তর থেকে:

পুথির বদলে মেলেনি কী নুন
পণ্ডিতও হয়নি কী খুশি একরকম,
লাভ কী আর জিইয়ে রেখে গতায়ু গৌরবের ভ্রূণ
কালের পাঞ্জায় সব যুগই যখন অক্ষম!

ভরসা বা বিশ্বাস নেই আর কোনোখানে। নিজের জন্মের সময় নির্ধারিত করে তোলার সুযোগ পেয়েও যেন কবি নিশ্চুপ! তিনি ফিরে দেখছেন, সমস্ত কাল অক্ষম, ‘গতায়ু গৌরবের ভ্রূণ’ কথাটা কী অমোঘ, আশ্চর্য উপায়ে বসিয়েছেন উনি এখানে, যার কোনো গতি নেই, যার আয়ু শেষ, অথচ যে জন্মই নেয়নি এখনও, অর্থাৎ আশা আর সম্ভাবনা! এই সময়ে জন্মযোগ্য নয় কিছুই!

“…যেখানে পেরেছ সেখানে লিখেছ, পাথরে লিখেছ, তামায় লিখেছ
নিজের গাথায় অযথা ভরাওনি কী ভূমির শরীর?
আসলে, অমর হতে চেয়ে বারবার মরেছ
আজ তাই জীবন হল নিশ্চল, আর সমকাল স্মৃতি-স্থবির।

তুমি যে মানুষ হয়ে কিনেছ অনেক সময়
এবার যেন শূন্য হয় তোমার সব সঞ্চয়।”

মানুষের ছদ্ম উল্লাস, ছদ্ম বীররস অকৃতকার্য পড়ে রয়েছে এখানে ওখানে। যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে একমুঠো বালি। যে বালি হয়ত কোনোকালে সিংহাসনের চূড়া ছিল, আর ঘুরে বেড়ায় পায়ে পায়ে, আলাদা হয়ে পড়ে নিজেরই এক অংশ থেকে অপর অংশে! তৈরী হয় “ফারাক”। মানুষের মুঠি আলগা হয়ে আসে, শূন্য হয়ে আসে ছদ্মনাম!

যেমন “জীবনের সাজঘরে” কবিতায় কবি প্রথম স্তবকে লিখছেন,

“নাটক শেষে শুরু হয়
নতুন জীবন কারো কারো,
তবে সে কখনোই মধুযামিনী নয়
নয় ছয়-দুগুণে বারো”

প্রথম থেকে পড়ে এসে, শেষে দাঁড়ালে দেখুন দুরকম অর্থ তৈরী হচ্ছে, এ হিসেব নয়, তাই এ নয়, ছয় দুগুণে বারো, আবার নয় ও ছয় শব্দদুটোর মাঝে কোনোরকম যতি বা কোনোরকম চিহ্ন না থাকায়, নয়ছয় শব্দবন্ধের কথাও আমাদের মাথায় এসে পড়ে। অর্থাৎ আমাদের সমস্ত বাস্তব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাক, ছত্রভঙ্গ হয়ে যাক সমস্ত। এই সমস্ত আসলে কী? সে কি আমাদের জীবন? সে কি এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড? না আসলে এই সমস্ত হচ্ছে বাস্তব, তার যত আঁক কষা, তার যত হিসেব নিকেষ, সেইসব।

পরের লাইনেই কবি লিখেছেন,
“মাপাজোখা যত মঞ্চের কারসাজি
লাগে না কাজে জীবনের সাজঘরে —“

অর্থহীন, এ জগৎপূর্ণ কামনা অর্থহীন, এ অস্তিত্বের অনটন সম্পূর্ণ অর্থহীন।

“ধুলায় ভরা মাঠে-ময়দানে
সবাই মরে, আবার সবাই বাঁচে!”

ভারতের হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি, রামধারী সিং দিনকর মহাশয়ের “রশমীরথী” নামে একশ’ চৌত্রিশ পাতার একখানা কবিতা রয়েছে, কবিতার বই, এই বইটি মহাভারত নিয়ে, সেখানে শ্রীকৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদের জন্য রাজত্ব ফেরত আনতে গিয়েছেন, আর দুর্যোধন তাঁকে বন্দি করার হুকুম দিচ্ছেন, তখন ক্রোধোন্মত্ত শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপ প্রকাশ করছেন দুর্যোধনের সামনে, প্রথমে কথায়, পরে দৃশ্যে…

“সব্ জন্ম মুঝি সে পাতেঁ হ্যায়
ফির লৌট মুঝিমে আতেঁ হ্যায়…

ইয়ে দেখ্ জগৎ কা আদি সৃজন্
ইয়ে দেখ মহাভারত্ কা রণ্
মৃতকোসে পটী হুয়ি ভূ দেখ্
পেহচান ইনমেঁ কাঁহা তূ দেখ্”

“জন্মের বা মৃত্যুর সময়” কবিতায় কবি অমিতাভ সেন বলছেন,

“মানসসরোবরে একেবারে মিশে যেতে চেয়ে
আমার সাথে ছিল সেদিন যারা,
মেঘে-মেঘে নিমেষে আকাশ ছেয়ে
হয়তো আজ তারাই ঝরাবে শান্তি ধারা”

মানসসরোবর পবিত্র স্থান, হিন্দুধর্মমতে, এমনকী তিব্বতেও ওই সরোবরকে পবিত্র বলেই গণ্য করা হয়ে থাকে। সেখানে মিশে যাওয়া বা মিশে যেতে পারা ইপ্সিত যাঁদের তাঁরা মহাত্মা, এ বিষয়ে কবি সন্দিহান নন মোটেই। কবির ভরসার আলো এসে পড়েছে তাঁদেরই ওপরে, তাঁরাই মুক্তির পথ চেনাবেন, যে পথ হয়ত বাস্তব থেকে সামান্য বেঁকে গিয়ে চলে গেছে পরাবাস্তবের সীমানা পেরিয়ে…

কবি নির্দ্বিধায় আবার ফিরছেন বাস্তবে, যে বাস্তব মাধ্যাকর্ষের চেয়েও বড়, সে টানে, নিয়ে এসে আছাড় মারে কঠিন, কঠোর মাটিতে!

“বেকার কাকে বলি
জীবিকা সাকার হলে?
পোড়ে কি নাভিকুণ্ডলী
স্মৃতিস্থবির অনলে?

মৃত্যুবীজে আবাদ যেন
বর্তমানের বাতিল জমিন”

অসম্ভব পারদর্শী হাতে ব্যবহৃত হয়েছে “আবাদ” শব্দটি। প্রথম চারটে লাইনে গড়ে উঠেছে সন্দেহ, দ্বন্দ্ব, শেষে দ্বৈতসত্তার অবস্থান, “মৃত্যুবীজে আবাদ যেন”! প্রহার হানছেন, আঘাত হানছেন বাস্তবের ওপরেই যা আঘাত হেনেছে ওঁর চিন্তার স্তরে।

“ঘোলা জলে ডোবে কেন
যা-কিছু সমকালীন?”

এই যে বাস্তবের ঘটনার মধ্যে দিয়ে তারও বেশি কিছু উপলব্ধি করার চেষ্টা, এই চেষ্টাই সার্থক করেছে কবির চিন্তাকে। “মৃতসাগর” নামে যে কবিতাটি বইয়ে রয়েছে তার প্রথম চারটি লাইন দেখুন,

“ছায়াহীন বালিপথে যারা
ছুটে গেল প্রাণ হাতে করে,
আগুণ তাদের করেছিল তাড়া
ঠিকানা লিখে ভূমধ্য সাগরে”

ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বিবাদ এবং সে অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত দেশগুলির সাধারণ মানুষদের পীড়া, মৃত্যু, ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায় আমাদের, অথচ সে ভাগ্য নিয়ে জন্মেছেন তাঁরাই, তাই “ঠিকানা লিখে”, তাই তাঁরা “destined”।

আলো বড় কঠিন, আলো অনটনের রূপক! আলো ‘ফারাক’ গড়ে তোলে মানুষে মানুষে, “আলোর বিকল্প” কবিতায় কবি লিখছেন,

“সাময়িক শান্তিতে দেখি স্তব্ধ তামসী তারা
ধ্বস্ত জমিতে উঠলে ইমারত ইত্যাদি”

ইত্যাদি শব্দচয়নে কবি নিজের ঔদাসিন্য প্রকট করেছেন, সে আর প্রচ্ছন্নে নেই। এই আলো যাকে আমরা মুক্তি ভেবে এসেছি, সেই আসলে অন্ধকারের বিপরীত, হয়ত শান্তির বিপরীতও!

“হাঘরের দল এগোয় কঠিন আঁধার ঠেলে
দেখবে যে তারা জগৎ অতি ভিন্ন,
চুক্তিমাফিক দানাপানি যদি মেলে
লাভ কী দেখে পারাবত-পালক শতচ্ছিন্ন!”

কথামালার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছলাম আমরা, চোখ মেলে চাইব, বইয়ের শেষ কবিতার দিকে, শেষ কবিতার গুরুত্ব অপরিসীম, হয়ত প্রথম কবিতার চেয়েও, কারণ সে রেশ রেখে যায়, সে আমাদের মনে এঁকে দিয়ে যায় পাঠ অভিজ্ঞতা।

এই অবিশ্বাসের যাত্রার ভেতরে কবি শেষে রেখেছেন আকাঙ্খিত আশাকে। যে আশা প্রেম নিজে। যা আলো রূপকের সামিল। কবিতার নাম, “সন্ত ভ্যালেন্টাইন”।

কে এই সন্ত ভ্যালেন্টাইন? অন্তর্জাল মাধ্যম বলছে তিনি, প্রেমের স্বরূপ! তাঁর অস্তিত্বই প্রেমের অস্তিত্ব।

“Saint Valentine supposedly wore a purple amethyst ring, customarily worn on the hands of Christian bishops with an image of Cupid engraved in it, a recognizable symbol associated with love that was legal under the Roman Empire; Roman soldiers would recognize the ring and ask him to perform marriage for them.”

যা সমস্ত অপর, যা সমস্ত কু, যা সমস্ত গড়ে তোলে ফারাক, বিভেদ, সেই সব মুকুটহীন রাজার বিপরীতে একা একজন বৃদ্ধ, একা দাঁড়িয়ে সন্ত ভ্যালেন্টাইন; আমাদের একমাত্র কাজ শুধু বিশ্বাস করা, এই অবিশ্বাসের যাত্রার ভেতর দিয়ে বিশ্বাস করা।

“শহীদ সন্ত ভ্যালেন্টাইন,
ক’রে অমান্য রাজার আইন।”

পাঠক হয়তবা খেয়াল করে থাকবেন, এই কথালাপের কোনো অংশেই সম্পূর্ণ কবিতাটা দেওয়া হয়নি, কারণ, এই কবিতাগুলির পাঠ অভিজ্ঞতা বিচিত্র, এক নৈরাশ্য জন্ম দেয়, সেই আঘাত সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত। কোথাও পৌঁছনোর, কোনো মহৎ বা বিরাট কার্য সম্পাদনার কোনো দায় নেই কবিতাগুলোর, আমাদের অস্থির, অমীমাংসিত সময়ের সঠিক চিহ্ন কবিতাগুলো। পাঠক নিজের সময়কে দেখতে পাবেন আয়নায়, এই বিশ্বাস অটল। কবিকে প্রণাম। তাঁর এই ভোগ কে প্রণাম।

বই : ফারাক
কবি : অমিতাভ সেন
প্রচ্ছদ : অমিতাভ সেন
প্রকাশক : ধানসিঁড়ি
মূল্য : ১৮০/-

ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply