ক্যামোফ্লেজ
কখনও কখনও আমার মৃত্যু চিন্তা আসে। নিজে মরে যাব, এমনটা নয়। তবে খুব সাধারণ জিজ্ঞাসা। মৃত্যুর পর কী হয়? মানুষের জ্ঞান থাকে? মানুষ তো নয়, আত্মা। আত্মা কী? আত্মা শক্তি। এগুলো শোনা কথা। বিশেষ কিছু জানা নেই। আত্মা কি আত্মীয় হয়? মৃত্যুর পর কাছের মানুষদের আত্মা চিনতে পারে? এই উত্তর পাওয়ার জন্য দৌড়াইনি। মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকে একা থাকার সময়, রাত ঠিক দু’টো এবং চারটের সময় আমার ঘুম ভেঙে যেত। অসুস্থ থাকার সময় নিয়ম করে এই দুটো সময়ে মা টয়লেটে যেতে চাইত। সদ্য হাঁটতে শেখা শিশু সন্তানকে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো করে মা’কে নিয়ে যেতাম। ওই সময়গুলোতে মায়ের আচরণে বুঝতে পারতাম, আমি মায়ের মানসকন্যা। যা একদিন তপতী হতে চাইত, হতে পারেনি, তার ছাপ সে ঋতুপর্ণার মধ্য দিয়ে টের পাওয়ার চেষ্টা করত।
আমি স্বেচ্ছায় রাবীন্দ্রিক ঘরানার গান শিখিনি। অথচ রবীন্দ্রনাথের গানই আমায় ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। একটু একটু করে বেদনার নাশ করেছে। এই গানের ভেতর দিয়ে মৃত্যুর পরও মায়ের সাথে জুড়ে থেকে গেছি। রোজ রাতে গান শুনতে এসে আমার পাশটিতে বসত মা। বিছানায় থাকা কাগজ উড়ে যেত। বিস্ময়ে ও অবচেতনে আমি গাইতাম একটার পর একটা রবীন্দ্রনাথের গান। মা’কে জিজ্ঞেস করতাম, কী গান শুনবে বলো। কানে সেই উত্তর না শোনা গেলেও প্রাণে গিয়ে ধাক্কা দিত মায়ের জবাব
‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না
আমি বাইব না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে গো’
গলা আটকে যেত, বুঝতে পারতাম ভেতরে ভেতরে প্রবল যুদ্ধ চলছে, ভেঙে যাচ্ছে নগরী, ধ্বংস হচ্ছে, রক্ত বইছে। মায়ের গন্ধ কর্পূরের মতো উবে যাচ্ছে। এই প্রবল কষ্টের পর্যায়গুলোতে রাতে প্রায়ই স্বপ্ন দেখছি, একটি পুকুর পাড়ে ঘাসের উপর বেঞ্চে বসে আছি, মা এসে কাছে বসছে, আদর করে বলছে, ‘কচি, আমার সাথে চল, এখানে তোকে দেখার কেউ নেই।’ এত কষ্ট পাচ্ছি যার জন্য সেই মায়ের ডাক তখন ভয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছি, ঘুমঘোরে বলছি ‘যাব না, আমি যাব না, বাবার কাছে থাকব।’ এভাবে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে আমার মা যেদিন শেষবার জোর করল, স্বপ্নে দেখলাম হাত ধরে টেনে মা পুকুরে নিয়ে যাচ্ছে, নিজের কাছে রাখবে প্রিয় সন্তানকে, সেদিন বাবার হাত ধরে প্রবলভাবে বললাম, বাবার কাছে থাকব। চিরকাল আমি বাবার কাছে থেকেছি। উৎসবে অনুষ্ঠানে মা মামাবাড়ি গেছে, বাবা আমায় নিয়ে চলে এসেছে। তবু, মৃত্যুর পর, সেই বাপ ঘেঁষা সন্তান যার ভেতরে মা নিজেকে দেখত, তাকেই নিয়ে যেতে চেয়েছিল, ভেবেছিল কাছে রাখবে। কিন্তু সন্তান মানা করার পর, আমার স্বাভিমানী মা আর কখনও আসেনি। ঢেউ ডাকলে যেতে নেই একথা বলা মা নিজের সন্তানকে জলে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে, হয়তো সেই লজ্জায় আর মা আসেনি।
দু বছর পর জ্যাঠতুতো দাদার কন্যাসন্তান জন্মেছে। পুটু। দাদা আমায় বলছে, এমন অনেককিছুই সে টের পেয়েছে যাতে তার মনে হয়েছে যে পুটুই তার কাকিমা। মানুষের মনের ভ্রম বা শুধু মনে হওয়া বলে কাটিয়ে গেছি। তখন পুটু যেন আমার কাছে শুধুই আমার তিন মাসের মেয়ে। বি. এড পরীক্ষা চলাকালীন ওকে কাছছাড়া করতে হয়েছে। ও মামাবাড়িতে। এক ভোর রাতে স্বপ্ন দেখছি, পুটু কাঁদছে, তীব্র অভিমানে গায়ের কাঁথা ছুঁড়ে ফেলছে, মায়ের গলার স্বরে বলছে ‘কচি, তুই আয়, আমি এখানে একা পড়ে আছি। আমায় নিয়ে যা।’ মৃত্যুর ওপার থেকে আমার মা এসেছে। অকালমৃত্যু তার কিছুই করতে পারেনি। মা আমাকে জীবন মৃত্যু নিয়ে সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিয়েছে। মৃত্যুর পরে জীবন ছাড়া আর কিছু নেই, কিচ্ছু না।
কুয়াশা
গলা জড়িয়ে ধরে পুটু বলল, ‘তোমার চোখের কুয়াশায়, আমি হয়ে গেছি তারা’। আশ্চর্য! একটু আগেই গান করছিল ‘তুমি আছ, আমি আছি তাই/ পৃথিবীতে হম হম হম হম’৷ কুমার শানুর গান। ওর বাবা মিউজিক সিস্টেম চালালে এসব গানই শোনে। ও শুনে শুনে মনে রেখেছে। ‘তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তারা’ এই গান শুনেছে কিন্তু মাঝের শব্দ ভুলে গেছে। মাঝের অংশে, ওর শিশুমন কুয়াশা শব্দকেই বসিয়ে দিয়েছে। পুপুর চোখে কুয়াশা! সত্যি তো! আমি ওকে দেখলে, চোখে বাষ্প জমে ওঠে। কুয়াশার মতো লাগে। মনে হয়, সেবকের শীতকালীন কুয়াশায় ট্রেন আটকে গেছে। এগোতে পারছে না। পাঁচ বছরের সামনে কুয়াশার পথে আটকে গেছে তিরিশ বছর! এমনিতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে পুটু অনেক কথা বলে। যেমন সেদিনই বলছিল, তোমার গায়ের গন্ধটা কী সুন্দর গো পুপু! কীসের গন্ধ পেল ও? যা লুকিয়ে রাখতে চাই আজীবন, সেই মায়ার গন্ধ? এমন গন্ধ আর তো কেউ পায়নি! পুপু ওর এক আশ্চর্য পৃথিবী। মাও নয়, বাবাও নয়। পুপু। সে বাপ মায়ের মাঝের এক জগৎ। বাবা মায়ের মধ্যে কাউকে বাছতে না পারলে পুপুকে বেছে নেওয়া যায়। পুটু আমার মাঝে কী দেখে, একমাত্র ওই বলতে পারবে। আমি ওর মাঝে আমাকে দেখতে পাই। যেখানে সেখানে ছবি আঁকতে বসে পড়ে। রঙ ভালোবাসে। বই ভালোবাসে। গল্প ভালোবাসে। সবাইকে নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। নভেম্বরে, শহরের শীতে একটি জবুথুবু শিশু কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় স্ট্রেচারে শুয়ে। ডাক্তার তার গায়ে আঙুল দিয়ে টোকা মারতেই যে হাসি একরত্তি পুটু হেসেছিল, সে হাসি ওর গায়ে এখনও লেগে। ঘুমের ঘোরে গুড়গুড় করে আঁচড়ে বুকে উঠে পড়লে টের পেতাম, ওই হাসি। এখন পুটু কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরে যখন বলে, ‘আজ সারাদিনটা কী যে ভালো কাটল পুপু!’ তখন ওর ছোট দুটো হাতের বেড়ায় থেকে যেতে ইচ্ছে করে। ওকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করে, ‘তুই আসতে এই কুয়াশাময় জীবনটা কী যে ভালো কাটল পুটু!’
ছবি – জ্যাক বার্নোস্কি