যার গই কর্ণফুলী

মধুপর্ণা নামের মেয়েটি দীর্ঘক্ষণ ধরে মনে এসেই যাচ্ছে আমার। নিচু হয়ে একমনে লিখে যাওয়া। ক্যালকুলাস ? নাকি হাইট অ্যান্ড ডিসটেন্স ? নাকি মোমেন্ট অফ ইনারশিয়া… ত্বরণ গুলিয়ে যাচ্ছে। সময় দৃশ্যাতীত। শুধু হঠাৎ ঘাড় উঁচু ক’রে অল্প হেসে তার তাকানো।

অবাক আমি ভাবছি, শেষ এগারো বছরে একদিনের জন্যেও তো সে আসেনি মাথায় আমার। হঠাৎ কী হ’ল আজ ! প্রথমে যেন ঝাপসা ঝাপসা। কেবলই নাম। তারপর
মধুপর্ণা মধুপর্ণা মধুপর্ণা
তিনবার উচ্চারণ করতেই মুখচ্ছবি স্পষ্ট। আবোলতাবোল চিন্তা ভেসে আসছে। ভালো আছে তো সে ! এই একটু আগেই একটা বড়সড় দুর্ঘটনার খবর শুনছিলাম কাজ করতে করতে। যাত্রাপালার সাংবাদিক কন্ঠ নিয়ে খেলতে খেলতে জানাচ্ছিলেন মৃত্যুর খবর।

মাসকয়েক আগে এক সন্ধেবেলা নদী পার হতে হতে বন্ধুকে বলছিলাম, আমি আর খবর দেখি না। সমস্যা হয় আমার। ভিতরে ভিতরে। নিবিড়তা ভেঙে ভেঙে যায়। অথচ খবর না দেখে কি উপায় আছে আজকাল ! খবর জোর ক’রে নিজেকে দেখাতে চায়। অপুর যে ছেঁড়া কাঁথাটা ছিল, শুধু তার চোখ দেখা যেত সামান্য ফোকর দিয়ে, টেনে হিঁচড়ে সেই ফোকর আরও বড় ক’রে খবর নিজের এলিয়েনের মতো মাথাটা গলিয়ে দিচ্ছে রোজ। অভ্যেস হতে হতে মন এখন আঁতকে ওঠা ভুলে গেছে। সবই কেমন আশ্চর্য রকমের স্বাভাবিক।

পিছনে নদী পড়ে আছে। ঘাটে শীতলার কাঠামো হাতছানি দিচ্ছে। সেই প্রথম দিন থেকে হাতছানি দিতে দিতে, যেমন কবিতার কাছে নিয়ে এসেছিল সে আমায়, আজও তেমন। মাটি ফুরোয়। তবু তার দৃষ্টি ফুরোতে চায় না কিছুতেই। বন্ধু বলছে, একাকিত্বকে তোমার বন্ধু ক’রে নাও। উত্তর দিচ্ছি না আমি বন্ধুর কথার।
পারছি না।

হাঁটছি
হাঁটতে হাঁটতে, হাঁটতে হাঁটতে এ কোন পাহাড়ে এলাম ! আচমকা দেখি, বাঁকবদলের মুখে সে বসে আছে। মাথার উপর রাশি রাশি পতাকা। তাতে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা—
স্বাধীনতা গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র
সে মানে ? কে ? ও তো মধুপর্ণা নয়। হঠাৎ কীভাবে বদলে গেল মুখ ! আর মধুপর্ণাকে তো আমি কখনো চাইওনি এই নীলিমার অন্তরাতে। কাওকেই চেয়েছি কি ? সম্ভবত নয়। মনেস্ট্রির জীবনাধিক সৌন্দর্য কাওকেই চাইতে দ্যায় না বোধহয়। তবে, যে মানুষটি থাকলে ভালো লাগত অনন্ত সময়, এ তো সেই-ই। অবিকল সেই নিরিবিলি চাহনি। যেমনটা প্রতিবার হয়। প্রতিটি মুহূর্তই অনাধিক্য কথার। মাঝারি পাথরের উপর চুপচাপ বসে থেকে থেকে তার হাইড্রেঞ্জা ফুলের মুহূর্ত‌। আর আমি কী বলেছি তাকে ? বলেছি—
শোনো…
শুনুন…
শোনো…
আমার সম্বোধনের রকম দেখে কৌতুক অনুভব করছে তার ভ্রু-যুগল। একটু বুঝি বেড়ে যাচ্ছে হাসি !
উত্তর নেই।
কীভাবে থাকবে উত্তর ! সে তো তার সমস্ত অসহ্য তীর কোনো এক অতীতেই ছুঁড়ে দিয়েছিল আমার দিকে। সাগ্রহে জড়ো করেছি সেই সমস্ত উপহার। অভয়মু্দ্রার তালুতে রক্ত শুকিয়ে গেছে। ভালো লাগা জমতে জমতে মনে হচ্ছে যেন, উপহার বেড়ে উঠেছে সহস্রাধিক।

সমতলের মানুষ আমি। পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি এসে জাপটে ধরছে শরীর। কোথাও আস্তানা নেই। বিশ্রাম নেব কোথায় ! পথের পাশেই বিছানা ক’রে শুয়ে পড়তে চাইছে মন। তার দেওয়া সমস্ত তীর গেঁথে নিচ্ছি মাটিতে। ঘুমোব তীরের বিছানায়। তবু দেখি, ভয় করছে শুতে। এতখানি নিক্ষেপণের পরও ব্যথা পাবার ভয় !

জেগে থাকতে পারছি না। চোখ বুজে আসছে…

ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply