আমার শহর, আমার যৌনতা, বর্ষা ও একটি ধর্ষণের কথা

নিমেষহীন প্রহরের দোতারা বাজে, ভেল্কিবাজ শহরটার লোভ, অতৃপ্ত রসনা মাখা, উষ্ণ রাতের ঋতু ভাঙা মসলিন গায়ে জড়িয়ে, স্নিগ্ধ পেলব পূর্ণিমার মসৃন দেয়া-নেয়াকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। সন্ধানী উলম্ব শিশ্নের মত বাতিস্তম্ভগুলো চেয়ে আছে আকাশের দিকে। তার মাথায় তখন অর্ধচন্দ্র। নুনে ভেজা আগুণ জ্বলছে যেন! যেন ভ্যাপসা গরমে ম্যাদা মেরে যাওয়া পুরুষের হলদেটে বীর্য! সরের মত অদ্ভুত ধোঁয়াটে কুয়াশার আবহে, ক্ষোভ, হতাশা আর আঘাতের এক শ্রেণীহীন রঙ্গমঞ্চ তৈরী হয়। দ্রোহ, বিপ্লব এমনকি ডালিম রাঙা রাতের অপরিচিত মুখ, সবাই সেখানে পুতুল শুধু। পিছনদিক থেকে দড়ি ধরে আছে পোড়া লাগা রাতের এই শহরটা। সংযমী দাবানলে যেমন বাতাসে অক্সিজেন কমে আসে, তেমন আত্মশুদ্ধিও তো হয়! কামজ তৃপ্তির আয়ু কমে গিয়ে তিরিশ সেকেন্ডে এসে ঠেকে। ভদ্রেশ্বরী কামায়ন শরীরী সার্কাসে আবোলতাবোল ভাদুর সুর ধরে। আমার নখে তখন ছুঁয়ে আছে মৃত গিটারের স্থবিরতা। ঠিক তখনই আত্মমগ্ন শহরটার চৌরাস্তার মোড়ে চারিদিক থেকে পুজোর গান বেজে ওঠে উত্তরে কিশোর, দক্ষিণে আশা। পুব কিংবা পশ্চিমে নাম না জানা কোন বাংলা ব্যান্ডের এলিট গণসংগীত! এইসব স্মৃতির টাকডুমাডুমের দৃশ্যকল্পে অনেকগুলো মানুষ এসে ঢুকে পরে তখন। এই স্মৃতি ব্যাকরণের সমস্ত মুহূর্তগুলো past perfect হয়ে নিমেষে গায়েব হয়ে যায় মারমুখী অতীতের কৃষ্ণকলির গাঢ় পলিমারে। মিলে মিশে যায় গুঁড়ো গুঁড়ো জলকণার যৌক্তিক কলতান। সিঁড়ি ভাঙা অংকে ধেড়িয়ে বসে থাকা পাঁচমিশালি জীবনের বিচিত্র ক্র্যাকাফোনি, ভাঙা ভাঙা শব্দের বিস্ফোরণ আনে, মেঘ-কুয়াশা আবৃত ধুলোময় পৃথিবীর সমগোত্রীয় কোন গ্রহাণুপুঞ্জে। তখন হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখলে আগু পিছু তিরিশটা বছর এসে মিশে যায় ঘরভাঙ্গা শূন্যতার ভিতর। কৈশোরের গন্ধ, যৌনতার গন্ধ মিলে মিশে টকটক একটা ঢেঁকুর আসে আলটাকরা বরাবর। শহরের যৌনাঙ্গে তখন ঝড় উঠেছে। শিল্পীর কলম যখন ম্যাজিকদন্ড, ঘুমপাড়ানি সুরের তালে তখন মুকরা থেকে অন্তরা হয়ে সমাপ্তিতে ফেরবার তাড়ায়, অনেকগুলো ছবি ভেসে ওঠে। যে ছবিগুলো ভিজে গেছে, সময়ের ঝরে যাওয়া ঘামে। গন্তব্যহীন কোন কালের স্রোতে সেগুলো ভেসে যায়। যেন একটা ডিভাইন যাত্রাপথ, স্পিরিচুয়াল জার্নি। স্বার্থপরতার গৌরচন্দ্রিকায় ভালো লাগা, মন্দ লাগাকে পেঁচিয়ে ধরে থাকে জটিল এক মনস্তত্ত্ব। শহরটার পেটের ভিতর সেধিয়ে যাওয়া শারীরবৃত্তিয় চিত্রকল্পে, কুঁকড়ে গিয়ে লেপ্টে থাকে এ মার্কা একটা ছবির পোস্টার। সিনেমা হলের গায়ের ফাটল বেয়ে বিষন্ন ঝাপসা কোন মাহেন্দ্রক্ষণে লোভের বিস্ফোরণ ঘটে। জন জাগরণ যেন! সেই ফাটল থেকেই মেঘরঙা অর্কিড মুখ বাড়ায়, অস্থির কোনো ঘূর্ণাবর্তের বিকেলে।

এই শহরেই ধর্ষণ হয় আষাঢ়ের এক অকপট বিকেলে। ধর্ষণে যতটা যৌনতা লেগে থাকে তার থেকেও বেশী থাকে ধর্ষকের নিম্নগামী মানসিক অবস্থান! সবই তো চাহিদা! কোনটা পশুর কোনটা সিস্টেমের। আমরা শুধু তেলমশলা মেখে রাত জাগি ভাঙাচোরা শহরের নষ্ট কোন ইউনিয়ন রুমে কিংবা অস্থায়ী লেবার রুমের ডাই সেকশন টেবিলে। ধর্ষণদৃশ্যে আমাদের নৈতিকতা, বোধ, শিক্ষা, সহনশীলতা স্থবির হয়। এক এক করে ধর্ষিতা হয় এরা সবাই। পরে থাকে কিছু উলঙ্গ শরীর, প্রতিবাদে কিংবা ভোগের থালায়! দেখতে দেখতে দৃষ্টি অসার হয় আমাদের। পক্ষপাত তখন যেন কর্তব্যের ভূমিকা নেয়। এ যেন এক সাধারণ রিফ্লেক্স! ঠিক রাজনৈতিক নেতাদের সুযোগের সদ্ব্যবহারের মত। ডাল আর চাল মিশিয়ে খিঁচুড়ি হয়ে যায় সব কিছু কিন্তু নিরপেক্ষ থাকা আর হয়ে ওঠে না। জটিল সমীকরণ হয়ে জীবন এসে দাঁড়ায়, নদী-সাগর পেরিয়ে ডেসপারেশন আর অর্জনের ঠিক মাঝ বরাবর। The Particle Theory of Light মেনে নিয়ে বিচ্ছুরিত নিয়ন আলোর রোশনাই এক কণা থেকে অন্য কণায় সরে যায় শুধু! বিকেলের স্নায়ুসূত্রে নির্লজ্জ জলজ জীবাণুরা জোনাক আলো জ্বালে। মৃত শৈবালের জীবাশ্ম মাখানো কলতলা জুড়ে, মানিক জ্যেঠুরা তখন গলা ছেড়ে গান ধরেন, “জনম আমার উতল দিল, আসমান ছাড়া সমুন্দুরে।” ধুতুরার গোলাপি স্তনে, কাজরীর কালো ভোমরা তখন মায়ামেঘের সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করে চলেছে যৌবনবতী বর্ষার মত, “বারাসান লাগি বাদাড়িয়া রুন ঝুম কে।”

 

ছবি – রবীন্দ্রনাথ

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By শাশ্বত বোস

জন্ম ১৯৮৯ সালের জানুয়ারী মাসে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুর শহরে । হুগলী জেলারই রিষড়া শহরে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ২০০৫ ও ২০০৭ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন । ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখালেখির সাথে যুক্ত। বিভিন্ন নামী পত্রিকা যেমন সন্দেশ, জোয়ার, কোরক, পথ ও পাঁচালি ইত্যাদি পরিবারের তিনি নিয়মিত সদস্য ছিলেন ।

Leave a Reply