সুস্মিতা হালদারের বড়ো গল্প এপ্রিল ফুল

এপ্রিল ফুল

এক

—“আমাকে Arpil Fool করতে এসো না। নিজেই Arpil Fool হয়ে যাবে। কারণ, দু’বার April বানানটা তুমি ভুল পড়েছ।”
হোয়াটসঅ্যাপে আসা একখানা মিম বন্ধুদের দেখিয়ে হাসির রোল তুললেন প্রণবেশ। পাশে বসে স্ত্রী মণিকাঞ্চনা। চুঁচুড়ার জোড়াঘাটে প্রায়ই বসে প্রণবেশের আড্ডা। বউয়ের সঙ্গে বিকেলে হাঁটতে এসে বন্ধু জুটেছে অনেক। বন্দে মাতরম্ ভবনের সামনের বেদিগুলোতে প্রায়দিনই বিকেলে ঠেক বসে। রাস্তার উল্টোদিকে ভ্যানগাড়িতে একটা ছেলে চা বিক্রি করে। বড় বড় করে লেখা ‘মোষের দুধের চা’। মোষ না গরুর দুধ জানা নেই। তবে বিকেলে এদিকে হাঁটতে এলে ছেলেটির কাছ থেকে প্রণবেশের এক কাপ চা খাওয়া চাই-ই। বেশ যত্ন নিয়ে বানিয়েও দেয় চা। যদিও দাঁড়াতে হয় খানিক। অন্তত শহরের অন্য চা দোকানগুলোর মতো ফ্লাস্কে বা কেটলিতে রাখা সকালের বাসি চা খাইয়ে খদ্দেরদের গ্যাস-অম্বল করায় না। প্রণবেশের তো তাই-ই মনে হয়। আজ অবধি ওর চা খেয়ে প্রণবেশকে পেটের সমস্যায় পড়তে হয়নি। আর এর দোকানের চা কাটেও ভালো। ছেলেটি আজও দূর থেকে প্রণবেশকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “দাদু, চা হবে না কি? আজ একটা নিলে আর একটা ফিরি, দিদিমারটা।”
—“খাবে চা?” স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন প্রণবেশ।
—“দুধ চা বারণ কিন্তু। ঘরে গিয়ে ঢেউ ঢেউ করে ঢেকুর তুলো না।” আলতো কড়া সুরে মণিকাঞ্চনা মনে পড়িয়ে দেন ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা। তবে তাতে ‘না’-এর চেয়ে ‘হ্যাঁ’টাই বেশি ছিল।
—“অত্তো বারণ আর মানা যায়?”
—“পরের সপ্তাহে চেক আপ। মনে আছে তো? দিয়ে ডাক্তারকেও এপ্রিল ফুল করবে। বলবে, ‘না না, দুধ চা আমি ভুলেও ছুঁই না।’ বোকা বানাও, বোকা বানাও। নিজেকেই বোকা বানাও।” কথায় চিমটি কাটেন মণিকাঞ্চনা।
—“বৌদি আজ বেশ ফর্মে আছেন তো।” ঠেকের একজন বলে ওঠেন।
—“আসলে কী বলুন তো বৌদি, ভেতো বাঙালির জীবনটাই একটা এপ্রিল ফুল।” অন্যজন একটু উদাসীন হয়ে দার্শনিক কথা বলেন।
—“কী গো বলে দিই তাহলে?” প্রণবেশ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকান।
—“দাও।” ছোট্ট উত্তর দেন মণিকাঞ্চনা।
—“আপনারা খাবেন চা?” ঠেকের অন্যদেরকেও জিজ্ঞাসা করেন প্রণবেশ।
ঘাড় নেড়ে সবাই ‘হ্যাঁ’ বলেন। চায়ের মতো জিনিস, তা কি না বলা যায়? এ তো বাঙালির রক্তে…
—“দিয়ে দাও ভাই। দু’টো চিনি ছাড়া। সুগার ফ্রি থাকলে দিও। আর এক দুই…” বাকি সদস্যদের সংখ্যাটা আঙুল দিয়ে গোনেন, “আর আট কাপ দেবে। দু’টো বেকারি বিস্কুট দিও।” ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বলেন ছেলেটিকে। ওকে বলা শেষ হলে স্ত্রীর দিকে ফেরেন, “এই যে এখন তোমার মনটা চা চা করছে, আর তুমি যদি ওইটে ‘না’ বলতে তবে নিজের সঙ্গে এপ্রিল ফুল হত। হ্যা, হ্যা, কী? ঠিক বলিনি দাদা?” প্রণবেশের কথায় বাকিরাও হাসতে থাকেন।
বুড়ো বয়সের ঠেক, কেমন যেন যৌবন ফিরে পান প্রণবেশ। একসময় তো বিরাট আড্ডাবাজ ছিলেন। আজকাল অবশ্য এখানে সবদিন আসতে পারেন না। বাড়িতে এটা-ওটা, অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। তাও বা আসতে চেষ্টা করেন, মনে হয় মণিকাঞ্চনা বাড়িতে একা হয়ে যাবেন। স্ত্রীকে ছাড়া আসতে মনটাও খারাপ খারাপ লাগে। এদিকে মণিকাঞ্চনার সময় হয় তো, মন হয় না আর মন হয় তো সময় হয় না। এই করে করে আসাটা অনেক কমে গেছে প্রণবেশের। মণিকাঞ্চনা অবশ্য এই আড্ডার শ্রোতা মাত্র। টুকিটাকি কথা ছাড়া সেরকম মুখ খোলেন না। যেটুকু খোলেন তাও স্বামীর সঙ্গে। সবার কথা শুনে হাসতেই তাঁর বেশি ভালো লাগে। আর একটা কারণে আসা। স্বামী আড্ডা দেন আর তিনি বোতলে করে ‘গঙ্গা জল’ ভরে নিয়ে যান। হলেই বা শাখা নদী, জলটা গঙ্গারই তো।
ছেলেটি একটা স্টিলের থালায় দশটি মাটির ভাঁড় সাজিয়ে নিয়ে এল। দু’টো ভাঁড়ের ওপর একটা করে বেকারি বিস্কুট। ওই দু’টো চিনি ছাড়া। সবাই ভাঁড় তুলে নিতে, প্রণবেশ দামটা দিয়ে দেন। গরম চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে এক কামড় দিয়ে মণিকাঞ্চনা বলেন, “জানেন, দাদা, একটা গল্প বলি আপনাদের…”
—“আজ বৌদি নিজের থেকে গল্প বলবেন। বেশ বেশ, শুনি।” ঠেকের একজন বলেন।
—“ঠিক গল্প বলা যায় না… আমার ছোটবেলার বোকামি। ছোটবেলায় না আমি এপ্রিল ফুল কী জানতাম না। পয়লা এপ্রিলকে বলতাম একলা এপ্রিল। ১লা… তা পয়লা তারিখ পড়তে না পড়তেই বাড়িতে ঠাট্টার রৈ রৈ রব পড়ে যেত। আমার বাপের বাড়ির লোকজন খুব রসিক ছিলেন। তা ওইদিন দিদিরা, দাদারা, তাদের বন্ধুরা সারাদিন ধরে খালি এর পিছনে ওর পিছনে লেগে বেড়াত। রাতে খেতে যাওয়া অব্দি চলত এইসব ঠকানো, খুনসুটি। আমি তখন বেশ ছোট, ঠকে গেলেই ওরা সব চেঁচিয়ে বলত, ‘এপ্রিল ফুল’। আমি ওদিকে ভাবতাম, এপ্রিল ফুলটা কেমন ধরণের ফুল? কোন গাছে ফলে? তখনও ইংরেজি সিলেবাসে ঢোকেনি। তা আমি তো ভেবেই পেতাম না, এই এপ্রিল ফুলের সঙ্গে ধোঁকা দেওয়ার সম্পর্কটা ঠিক কী। দাদা-দিদিরা বোঝাত। আমি ক্যাবলার মতো ঘাড় নাড়তাম। তবু কিছুতেই মাথায় এঁটে উঠত না। এই ছিলাম আমি। কী বোকা!” হয়তো তেমন মজার কথা নয়। তবু ছোটবেলার একটা আবেগ। মণিকাঞ্চনার হাসির সঙ্গে অন্যরাও হেসে উঠলেন। চায়ে মন দিতে দিতে সেইসব দিনগুলোর কথা মনে করেন। হাতের কড় গুনে হিসেব করেন। আজ তাঁর বয়সের হিসেবে ৬৬তম ১লা এপ্রিল।

দুই

চা শেষে হাতটা কোমরে গোঁজা রুমালে মুছে নেন মণিকাঞ্চনা। প্রণবেশ বন্ধুদের সঙ্গে একটার পর একটা গল্প জুড়ছেন। মণিকাঞ্চনা কিছু শুনছেন, কিছু না। নিজের মনে শাঁখা-পলা, সোনার বালাগুলোয় হাত বোলাচ্ছেন। একাকী চিন্তায় মগ্ন। ভাবেন, পুরনো দিনগুলো। সেই ছোটবেলার বোকা মেয়েটা এখন দস্তুরমতো সংসারী। অনেক ঝড়ঝাপটা সামলে খানিক থিতু হয়েছেন, বুড়ো বর, মেয়ে-জামাই আর দুই যমজ নাতি-নাতনি নিয়ে। মধ্যবিত্তের স্থায়িত্ব, সে বড়ই অস্থায়ী। ভাবে, কবে যে থিতু হব! আবার থিতু হয়েও জ্বালা। জীবনটা কেমন যেন জাঁতাকলে আটকে পড়েছে মনে হয়। একটা বয়সে ভাবতেন, নিজে যে কবে বাবাকে কন্যা দায় থেকে মুক্ত করতে পারবেন! তারপর বিয়ে হল, মেয়ে হল একটি। সে বড়ও হল। চিন্তা, মেয়ের বিয়ে। ভালো ছেলের সাথেই বিয়ে হল মেয়ের। মেয়ে-জামাই মণিকাঞ্চনাদের সাথেই থাকে। একটু থিতু হতে যায়, মেয়ের বাচ্চা হওয়া নিয়ে সমস্যা। বিয়ের প্রায় দশ বছর পর বাচ্চা এল। কতবার যে বাচ্চা নষ্ট হল। কত জায়গায়, কত ঠাকুরের কাছে যে মানত করেছেন। তারপর এই গত মাসে মানত ফলল। এবার তাই বড় করে অন্নপূর্ণা পুজো করালেন। পুজোর জোগাড়, লোক খাওয়ানোর ব্যবস্থা, এসব করে আর বাড়ি থেকে নিজের জন্য বেরনো হয়নি। কাল বিসর্জন ছিল। আজ তাই একটু হালকা হতেই বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছেন।
বিকেলে হাওয়া খেতে বেরনো মানেই গঙ্গার ঘাটে এসে বসেন। কোনওদিন বুড়োবুড়িতে। কোনওদিন আবার একাই। তবে প্রণবেশ বউকে ছাড়া একলাটি আসতে চান না। ময়ুরপঙ্খী, বকুলতলা, জোড়াঘাট এই তিনটেতেই ওঁরা ঘুরে-ফিরে আসেন। তবে প্রণবেশের সঙ্গে হাঁটতে বেরোলে জোড়াঘাটে একবারটি হলেও আসা চাই-ই।
—“তুমি গল্প করো আমি একটু ওদিক থেকে আসছি।” বরকে বন্ধুদের ঠেকে বসিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন মণিকাঞ্চনা। যৌবনে খুব ছবি তোলার শখ ছিল। বিয়ের পর পর প্রণবেশকে বলেছিলেন সেই শখের কথা। প্রণবেশ একটা ক্যামেরা কিনে দেন। রিল ভরা। নব্বইয়ের দশকে কেনা। বেশ দামি। দাম পড়েছিল হাজার দশেক মতো। এখন সে বেখেয়ালে খারাপ হয়ে পড়ে আছে। এখন এই বড় ফোনই সম্বল, অ্যান্ড্রয়েড। ঘাটে এলেই ছবি তোলেন। সিঁড়ির ধাপে জমে ওঠা পানার, গঙ্গার পলির। ফোনের ক্যামেরা খুলে ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে এক পা এক পা করে নামতে থাকেন। পড়ন্ত বিকেল, সন্ধ্যে নামছে। পিছনের বাড়িগুলোর আড়ালে চলে গিয়েছে সূর্য। আকাশে সোনালি আভা। ক’দিন ধরেই মেঘলা করে আছে সারাটাদিন। মাঝে মাঝে রোদ উঠছে। ঠাণ্ডা, গা শিরশিরে হাওয়া। বসন্তে ঢুলন্ত বর্ষার আমেজ। ঘাটের সিঁড়িতে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে কুকুরগুলো। প্রেমীযুগল, দম্পতিরা নিজেদের মধ্যে মেতে। তাদের বাঁচিয়ে ছবি তুলতে থাকেন।
সিঁড়ির শেষের দিকের একটা ধাপে নামতে গিয়ে পা সরিয়ে নেন। মা কালীর কাটা মুণ্ডু পড়ে।
—“ইস্! কী অবস্থা মানুষজনের। আক্কেল জ্ঞানও নেই।” নিজের মনেই বিড়বিড় করেন। পা সামলে দু’হাত মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করে নেন। পর পর ধাপগুলোয় গতকালের বিসর্জনের চিহ্ন লেগে। বাসি গাঁদার মালা, মাটির কলসির টুকরো, ঠাকুরের চুল। দেখেশুনে পলি পড়া ওই ধাপটাতেই বসে পড়েন। হাঁটুতে ব্যথা, তাই অনেক কষ্টে পা মোড়েন, যন্ত্রণায় কোঁকিয়ে উঠে। ঝুঁকে দেখেন মা কালীর বিচ্ছিন্ন মাথা। মায়ের চোখের মণি মুছে গেছে গঙ্গার জলে। জিভ বেরিয়ে, অক্ষত অবিকল। যেন কিছু দেখে লজ্জায় জিভ কেটে চোখ মুদেছেন। হাতজোড়া আরও একবার কপালে ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলেন, “ক্ষমা করো মা গো।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ান। নামেন শেষ ধাপটায়। গঙ্গার জল এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে ঘাটের সিঁড়ি। একটু গঙ্গাজল হাতে নিয়ে মাথায় ঠেকান। খানিক শাড়ির খুঁট ভিজিয়ে গিঁট্টি বাঁধেন। বরের মাথায় দেবেন বলে। ক্যামেরায় দেখেন মা গঙ্গাকে। সিঁড়ির অদূরে পাঁকে মুখ থুবড়ে পড়ে একটা ঠাকুরের কাঠামো। কোন ঠাকুর বোঝা যায় না। অর্ধেক পাঁকে আটকে। পাশে পড়ে কচুরিপানা, বাসি ফুলের মালা, শুকনো আকন্দ, ছেঁড়া চাঁদমালা আর একটা থামস্ আপের খালি বোতল। পুজোর দিনগুলোয় কত মানা হয়। ঠাকুরের গায়ে যেন পা না লাগে। পুজোর জিনিসে পা লাগলে তা পাল্টে নতুন আনা হয়। কত মানত ঠাকুরের কাছে। সব অসহায়তা আকুল হয়ে উজাড় করে ঠাকুরের কাছে। পুজোর ফুল, সিঁদুর সরিয়ে রাখে। দুর্বল মনের সম্বল ভক্তের ভক্তি। আর পুজো শেষে সেই মূর্তিই বড় অসহায় ভক্তের হাতে। মণিকাঞ্চনা নিজেরই তোলা ছবিটা বারবার দেখেন। ছবি আর বাস্তব। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলেন। ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা খুলে নিজের ওয়ালে যান। ছবি দু’টো আপলোড করে পোস্ট করেন। ট্যাগলাইনে লেখা,
‘ভক্তের ভক্তি পাঁকেতে লুটোয়। ভক্তির চিরন্তন ‘এপ্রিল ফুল’ খেলা।’

ছবি – লেখক

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By সুস্মিতা হালদার

শখ: নাচ, সাহিত্যচর্চা । পূর্ব প্রকাশিত বই : লায়েক গাথার নায়ক খোঁজে, মেঘমিতালীর গল্পসকাল, কবিতার গল্পেরা

Leave a Reply