কোচিং থেকে বেরিয়ে দুটো সাইকেল চলছে পাশাপাশি। ফরহান আর অদ্রিজা। ওরা এভাবেই অনেক অনেক দূরে যেতে চায়। কিন্তু উপায় নেই। প্রথমত শুরু হবে হাইওয়ে। আর দ্বিতীয়ত এখানেই জায়গা দখল করে গজিয়ে উঠেছে লেবেল আঁটা মৌলবাদী একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়। চোখে পড়লেই বসে যাবে সালিশি সভা। তাই ওরা সাইকেল ঘুরিয়ে নেয় বাঁ দিকের গলির মুখে। এখান থেকে যাওয়া যায় কর্ণগড়। সেখান থেকে আঁকাবাঁকা পথ ধরে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে পড়ে রানি শিরোমণি গড়। সেই জায়গা যা একসময়ের চুয়াড় বিদ্রোহস্থল। রানি শিরোমনির প্রাসাদ থুড়ি জমিদার বাড়ি ছিল এখানেই। এখনও আছে ধ্বংসাবশেষ। এখন সৌন্দর্যায়ন হয়েছে। ওদের দাবি মতো এখানের একটি জরাজীর্ণ মন্দির ও একটি ক্ষয়িষ্ণু জীর্ণ স্থাপত্যের জুটেছে রাজ্য সংরক্ষিত স্মৃতিসৌধের মর্যাদা।

এই অঞ্চল জুড়েই তাদের প্রেম খানিকটা ডানা মেলার সুযোগ পায়। তাই সাইকেলে কয়েক কিলোমিটার পথ তাদের কাছে নস্যি।

নামটা ভারী মিষ্টি ‘পারাং’। গড়ে ঢোকার ঠিক আগে পড়ে এই নদী। তার ধারে সাইকেলে রেখে প্রায়ই পাশাপাশি বসে মাধবীলতা আর ফারহান। অদ্রিজাকে ভালোবেসে ফারহান এই নাম দিয়েছে কালবেলা থেকে তুলে এনে। আর মাধবীর চোখে ফারহান, তার নিজের পুরুষ চির যুবক। তাই তো অধিকার ফলানোর মানুষটার নাম সে দিয়েছে ‘যুবক’।

আজ গড়ের ভেতরে ঢুকলেও সেখানে বেশিক্ষণ থাকল না ওরা। একধারে সাইকেল রেখে নদীর ধার বেয়ে হাঁটতে লাগল। এভাবেই পুরানোর ভেতর থেকে পুরানোকে খুঁজে চলে। যদি পাওয়া যায় আরও অজানা কোনও প্রাচীন চিহ্ন। ইতিহাস খুঁজে চলার এই নেশাই তো এক করেছিল দু’জনকে। এভাবেই ওরা খোঁজ পেয়েছে রানির সেনোটাফ, পাথরে খোদাই করা পদযুগল চিহ্ন আরও কত কী। রোজই যে কিছু না কিছু পায় তেমন নয়। তবু খুঁজে চলাতেই ওদের আনন্দ। ক্লান্ত হয়ে গেলে ওরা বসে পড়ে নদীর ধারে। পা ডুবিয়ে দেয় নরম স্রোতে। আজ সেরকম না বসে এগিয়ে যেতে থাকল আরও…

বসন্তের বিকেলে কোকিলের ডাক শুনতে শুনতে হাঁটছে দু’জনে। মাধবী কখনও খোঁপা করে নিয়েছে চুল। মাটি থেকে কুড়ানো কৃষ্ণচূড়া সেখানে গুঁজে দিয়েছে যুবক। মাধবী এখনও জানে না আজ তাকে কী উপহার দেবে তার প্রেমিক। প্রতিবার দেখা হলেই ঠিক সূর্যাস্তের সময় ছোট ছোট উপহার দেয় ফারহান। ওই সময়টার নাম ওরা দিয়েছে ‘আবেগ’‌।

হাত ধরে মেঠো রাস্তা বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল অদ্রিজা থুড়ি মাধবী। আনন্দে। ফারহান তাকিয়ে দেখে সে আঙুল দিয়ে ইশারা করছে দূরে, একটা কুঁড়ে ঘরের দিকে। এ গাছ অচেনা নয়। খুব ভালোবাসে ফারহানও। মাধবীলতা। থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে। মাধবীর জেদ ওইখানে যেতে হবে। অগত্যা…

মেয়েটা ছোট ছোট জিনিসেই কী অদ্ভুত খুশি হয়। এই সরলতাকেই ভালোবেসেছে ফারহান। মাধবী ততক্ষণে শিশুর মতো বকে চলেছে, ওই দেখো গাছে আমি ফুটে আছি। আমি দুলছি।

ওর কাণ্ড দেখে হাসতে থাকে ফারহান, আমাদের মাধবীর যুবক। হঠাৎ কী ভেবে যেন শুকিয়ে যায় ওর মুখ। দুটো হাত দিয়ে আলতো করে ধরে ফেলে মাধবীর মুখ। খুব আস্তে আস্তে বলে, “আমরা যে গাছটাকে মাধবীলতা বলি তার নাম আসলে মধুমালতী। অনেক অনেক পরে এই ভুল ভেঙেছিল আমার। কখনও বলা হয়ে ওঠেনি। তুমিও মিথ্যে হয়ে যাবে না তো এঈ ভুলের মতো?” মাধবীর উত্তর, “ফুলের নাম না হয় ভুল জানতে কিন্তু যা দেখে এই ফুলকে ভালোবেসেছিলে তা তো মিথ্যে নয়। মৌলবাদের ঝড় যখন আমাদের আলাদা করতে পারেনি তখন আর কেউ পারবে না। বিশ্বাস করো।” দুজনের মধ্যেই ফুটে ওঠে হাসি। তাতে লেগে আছে যোদ্ধার আত্মবিশ্বাস আর ভালোবাসা। প্রেমিকার হাতে হাত রেখে ফারহান বলে, মানুষ বা কোনও কিছুকে ভালো না বাসলে হয়ত যুদ্ধ করা যায় না। মাধবী বলে, তা কি আর আমরা বুঝি না? এই যে এত লড়াই…

সূর্যাস্তের নরম আলো ওদেরকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করল মাধবী। চোখ বন্ধ করলেই যে উপহার। ফারহান ব্যাগ একটা পলাশের মালা বের করে পরিয়ে দিল তার গলায়। হাতে দিল একটা শিমুল। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, আজ তোমায় দিলাম একটা আস্ত বসন্ত। মাধবী চোখ খুলেই আবার হাসতে লাগল। এই হাসির নাম লজ্জা। তখন দূর থেকে ভেসে আসছে লালনের সেই গানটা। যে গানটা ওদের খুব প্রিয়। থাক না ব্যক্তিগত।

ছবি – লেখক

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By নিসর্গ নির্যাস মাহাতো

শখ: লেখালেখি। প্রকাশিত বই: ভেঙে যায় চৌকাঠ দেশ ও বাড়ি, কর্ণগড়ের মর্যাদা। সম্পাদক: ম্যাগাজিন।

One thought on “পারাং নদীর ধারে…”

Leave a Reply