হঠাৎ এক সন্ধ্যায় থুতনিতে তিল ওয়ালা মেয়েটির সাথে দেখা হয়ে গেলে, একখানা চায়ের দোকান খুঁজে নিতে হয়। লাল চায়ের সাথে দু-একটা নোনতা বিস্কুট হাতে আসে মিনিট পাঁচেক পরে। এরমাঝে আপনাদের কথা হয়নি টুকটাক করেও। এক বিচ্ছিরি গুমোট কাটাবার জন্য আপনি তার দিকে একবার আলতো করে তাকাবেন। আপনি দেখবেন, রোগা সেই মেয়েটি যেন আরোও কিছুটা রোগা হয়েছে। এলোমেলো চুলের আড়ালে থাকা উদাসীন চোখ দুটো চায়ের দোকানে জ্বলতে থাকা ফ্লুরোসেন্ট বাল্বের দিকে নিবদ্ধ।
– ” জানিস, ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময় একদিন হুট করেই নেমে পড়ব কোনো অজানা এক গ্ৰাম্য স্টেশনে। কিংবা মাঠের মাঝে দিয়ে, জঙ্গলের মাঝে দিয়ে একটা এলো চুলের মেয়ে ঠিক মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি কাটলে যেমন হয়, ঠিক তেমন রাস্তায় সর্ষে ক্ষেতের মাঝে বরাবর, অনেক দূর কিংবা আমাদের ওই ঘন জঙ্গল, তার মাঝ বরাবর ওই রাস্তাগুলো, হ্যাঁ ফেরার গাড়ি হয়তো দিতে পারেনা, তবে আমি নিশ্চিত, এমন কোথাও নিয়ে যায় যেখানে থেকে ফিরতে মন চায়না। শুধু নেমে পড়লেই ব্যাস!”
হয়তো সেই রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছি, ক্ষেতে কাজ করতে থাকা একদল মানুষ মানুষীরা আমায় বলবে,
“এটে কোটে আসিছেন? কোটে থেকি আসিছেন? ”
ওদের কথায় ঘোর কাটলে বলব, “জলপাইগুড়ি।”
” জলপাইগুড়ি! তায় কার বাড়িত যাছেন সাগাই খাবার?”
আমি ওদের বলব আমার এমনি এমনিই এখানে পৌঁছে যাওয়ার গল্প। এমনি এমনিই যে এখানে কেউ পৌঁছাতে পারে এটা ওদের বিশ্বাস হয়না। বিশ্বাস না করেই ওদের মধ্যে একজন বলবে, ” তায় এলা খাওয়াদাওয়া? চিনেন না তো কিছুই। তার মইধ্যে দোকানপাটও তো সেমন নাই।”
যখন এদের আশ্বাস দেব, কিছু একটা জোগাড় আমি করেই ফেলব, ওদের মধ্যে একজন বলবে,
” ওইযে দেখেছেন গামলা। গামছা দিয়া বান্দা। ওইযে ওইঠে ভাত, আলুর সানা আর মরিচ আছে।সকাল থেকি খাং নাই । হামার বাউটা দিয়া গেইল একনা আগোত। এইলায় মুঠামুঠি করি খান এলায় হামার সাথোত।”
আমার শহুরে বিবেকে এবারে বাঁধা পড়বে। সক্বাল থেকে কিছু খায়নি, এখানে আবার ভাগ বসাবো?!
কিন্তু ওরা গ্ৰামের লোক। আধুনিকের ছোঁয়া প্রাপ্ত গ্ৰাম নয়, সেইসব প্রাচীন গ্ৰামের লোক, তারা আমার কথা শুনবে কেন?
আমায় এবারে বসতে হবে জমির আইলে। আমার পাতে দেবে ওরা ওদের অর্ধেক খাবার। দূর থেকে একটা ছোট্ট মেয়ে, পাতলা লাল চুলের ধরন, গায়ের রং সামান্য চাপা, তবে মুখের গড়ন বেশ স্পষ্ট, আমায় দেখে সে হাসবে।ওর গায়ের জামাকাপড়ে ধুলো লেপে আছে। ওর ভিষন লজ্জা। কোনো এক শহুরে দিদির সামনে যেতে তার মনে সাহস হয়না!
এমনি এক শীতের দুপুরের রোদে জমির আইলে বসে খেতে খেতে সেই লোক গুলো ও মহিলা গুলো আমায় অনেক কথা বলবে। তারা হয়তো বলবে,” যখন আসি গেইসেন, এলা তো আর যাবার গাড়ি বা টেরেন নাই। একেরে বিকালোত একটা আইসে। থাকেন হামার সাথে আজি।”
পাশের থেকে একজন হয়তো বলবে,” জল নাগিবে নাকি? মরিচটার খিব ঝাল! মাইক্রো, মাইক্রো।”
কেউ কেউ বলবে,” জলপাইগুড়ির ওই রাস্তা খান এলা আছে অমনে?” কিংবা,” ওই বিল্ডিংটা।”
ওদের কেউ কেউ নাকি যায় সেখানে, মাঝে মাঝেই।
একটু পর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটির নাম আমি জানতে পারবো। পাশের থেকে এক মহিলা ভাত মাখতে মাখতে মেয়েটাকে বলবে,” এইঠে আয়। দেখেক শহর থেকি দিদি আসিছে। অনেক দুর পড়ালেখা ! এইঠে আয়, কিসের না শরম?”
ওর এবারে একটু লজ্জা ভাঙবে। মুখের মধ্যে একটা আঙুল ঢুকিয়ে ও আলতো করে হেঁটে আসবে। ওর মুখে একটা লাজুক হাসি।একটু পাশে এসেই, একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াবে। এইবারে আমি বলব, ” তোমার নাম কি?” ও নাম বলবে না। শুধু হাসবে। পাশের থেকে ওর মা বলবে, ” ক কেনে নাম খান!” ও তাও বলবে না। ওর মা বলবে,” উয়ার নাম পুঁচকি। জবা ভালো নাম। এইবারে ক্লাস টু-ওত পড়েছে। ”
এইবারে মহিলাটি চোখে উজ্জ্বলতা এনে বলে,” বড়ো হয়া হামাও দিদির মতো কলেজ জামো, না মাগো?”
এইবারে আমার খাওয়া শেষ হবে। আমি উঠব উঠব করবো দেখে পুঁচকির মা বলবে,” দিদিক গ্ৰাম খান নেবরে আন কেনে।”
আমি মেয়েটির পেছনে গুটি গুটি পায়ে ঘুরে আসব সেইসব প্রাচীন গ্ৰাম, থেকে শহুরের দিকে।
চা শেষ হতে আর এক চুমুক। রাস্তা দিয়ে দূরের মোমবাতি মিছিল ক্রমশ কাছে আসতে থাকে । থুতনিতে তিলওয়ালা মেয়েটির চোখ গুলো ফ্লুরোসেন্ট আলো থেকে সরে পড়ে মোমবাতি গুলোর দিকে। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়ে। অস্পষ্ট ভাবে বলে,” জানিস পুঁচকির আর কলেজে পড়া হয়না! পরদিন সকালে রেললাইনের পাশের জঙ্গলে চিরকাল পড়ে থাকে সে!”
মিছিল আরো কাছে আসে । মোমবাতির আলোর তীব্র আকর্ষণ সে আর রুখতে পারেনা। হন হন করে মিশে যায় সে মিছিলের সাথে।
ছবি – দিবাকর সিনহা রায়