নির্বাচনের রঙ
রাত বাড়ছে। নিস্তব্ধ শহরের বুকে মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক শোনা যায়। রাকিব বারান্দায় বসে আছে, হাতে সিগারেট। ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে হারিয়ে যাচ্ছে। নিচে, গলির মোড়ে কয়েকজন যুবক জটলা পাকিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা করছে। আজ শহরের বিভিন্ন স্থানে মারামারি হয়েছে, একজন মারা গেছে।
রাকিবের মাথায় অন্য চিন্তা। সে বসে আছে মিতুর ফোনের অপেক্ষায়। মিতু—তার ছেলেবেলার বন্ধু, প্রথম প্রেম, এখন শুধুই স্মৃতি। দুজন একসঙ্গে বড় হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সেরা সময় কাটিয়েছে একসঙ্গে। একসময় ভেবেছিল, দুজন একসঙ্গে থাকবে সারা জীবন। কিন্তু পৃথিবী সহজ ছিল না। রাজনীতি তাদের ভাগ্য আলাদা করে দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই রাকিব রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। শুরুতে শুধু আদর্শের টানেই গিয়েছিল, পরে বুঝতে পারে, ক্ষমতা কীভাবে বদলায় মানুষকে। কিন্তু তখন সে ফিরে আসতে পারেনি। অল্প সময়ের মধ্যেই সে দলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মী হয়ে ওঠে। মিতু ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। সে পড়াশোনা আর ব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল। ভালোবাসত শিল্প-সাহিত্য।
দুজনের পথ দুইদিকে মোড় নিলেও বন্ধুত্ব অটুট ছিল। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো যখন মিতুর বাবা দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে পড়লেন। রাকিবের দল তখন ক্ষমতায়, আর দলের উচ্চপদস্থ নেতারা মিতুর বাবার বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করল। রাকিব চুপচাপ ছিল, কিন্তু মিতুর চোখে সে পরিণত হলো শত্রুতে।
আজ রাতে মিতুর ফোন আসার কথা। অনেকদিন পর। সে কি শুধুই পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দেবে, নাকি কিছু জানতে চাইবে? রাকিব জানে, তার দলের নেতা ইকবাল সাহেব বড় ধরনের দুর্নীতিতে জড়িত। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে কিছু লোককে বলি দেওয়া হবে। তার মধ্যে মিতুর বাবার নামও থাকতে পারে।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল।
—”রাকিব, কেমন আছ?”
—”ভালো। তুমি কেমন?”
—”ভালো থাকার প্রশ্নই আসে না। বাবা জেলে, মামলার অবস্থা ভালো না। তুমি তো জানো, সব বানানো মামলা। কিছু করতে পারবে না?”
রাকিব চুপ। সে জানে, চাইলেই কিছু করতে পারে। কিন্তু সে কি করবে? দলের বিরুদ্ধে যাবে? নাকি বন্ধু ও প্রথম প্রেমের জন্য নিজের অবস্থান ত্যাগ করবে?
—”রাকিব, কিছু বলছ না কেন?”
—”আমি চেষ্টা করব…”
—”তুমি চাইলেই পারো। কিন্তু করবে কি?”
রাত গভীর হয়। রাকিব জানে, তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একদিকে দল, যেখানে তার ভবিষ্যৎ, ক্ষমতা, অর্থ। অন্যদিকে মিতু, যে তার অতীত, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা। সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়, উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকে। তার মনে পড়ে, ছোটবেলায় মিতু তাকে বলেছিল, “সত্যের জন্য যদি কাউকে ছাড়তে হয়, তবে তা ছাড়া উচিত।”
আজ সে কী করবে?
পরদিন খবরের কাগজে আসে—ক্ষমতাসীন দলের তরুণ নেতা রাকিব দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। তিনি জানান, দুর্নীতির সব প্রমাণ মিডিয়াকে দেবেন।
এক সপ্তাহের মধ্যে রাকিব নিখোঁজ হয়ে যায়।
মিতু জানালার পাশে বসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে—”সত্যের জন্য কতোটা মূল্য দিতে হয়!”