শিরোমণির সোনার হুঁকো

কালবেলা কি পুরানো? ওদের তো পুরানোতেই আকর্ষণ। তাই মফঃস্বলের এই দুই ছেলে মেয়ে আর পাঁচটা প্রেমিক- প্রেমিকার মতোই হয়ে উঠেছে অনিমেষ ও মাধবীলতা। সমরেশবাবুর অনিমেষের সিগারেটে আসক্তি ছিল না। তবে এই যুবক থুড়ি অনিমেষের আছে।

ওদের শখ গন্ধ শোঁকা, চাপা পড়ে যাওয়া ইতিহাসের। ওই গন্ধ শুঁকেই মাটির তলা থেকে তুলে আনতে চায় অজানা কথা। তাই সাজানো গোছানো দুর্গ-রাজবাড়ির চেয়ে ওরা ছুটে চলে জীর্ণের খোঁজে। সুকুমার রায় ধার করে নিজেদের শখের একটা অদ্ভুত নাম দিয়েছে ওরা, ‘গন্ধ বিচার’।

যুবক ও যুবতী এখন মেতেছে চুয়াড় বিদ্রোহের গলিঘুঁজির পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়ে। অবশ্য ব্রিটিশ বিরোধী এই বিদ্রোহের ‘চুয়াড়’ নাম নিয়ে আরও অনেকের মতই তীব্র আপত্তি দুজনের। বিদ্রোহে চুয়াড় উপজাতি শামিল থাকলেও থাকলেও তা শুধুমাত্র চুয়াড়দের ছিল না। বিভিন্ন জাতি ও উপজাতি যোগ দিয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী এই বিদ্রোহে। ইংরেজরা বিদ্রোহকে হেয় করার জন্য নাম দিয়েছিল ‘চুয়াড়’। গোঁয়ার বোঝাতেই এই শব্দ প্রয়োগ।

১৭৯৮-৯৯ সালে এই বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায়ের আঁতুড় ঘর ছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনির কর্ণগড়। এখান থেকেই রাজ্য থুড়ি জমিদারি চালাতেন রাজা অজিত সিংহের দ্বিতীয় স্ত্রী রানি শিরোমণি। তিনিই ছিলেন বিদ্রোহের নেত্রী। তবে তাঁর বিদ্রোহ পরিচালনা ছিল আড়ালে থেকে। তারপর ইংরেজদের গড় দখল- গ্রেফতারি-বন্দি-বিচার-মুক্তি- রহস্য মৃত্যু… ইতিহাসের অস্তিত্ব যেখানে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ওই অঞ্চলের নাম রানি শিরোমণি গড়। পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে সরু পারাং নদী। সম্প্রতি এখানে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। খাতায় কলমে জুটেছে রাজ্যের প্রত্নতাত্ত্বিক মর্যাদা। এখানে প্রায় ৫-৬ বছর ধরে আনাগোনা লেগে আছে ওদের।

শিরোমণি গড়ের সংরক্ষিত জীর্ণ মন্দির ও ধ্বংসস্তূপের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে এক বিকেলে মাধবীর কানের কাছে মুখ এনে অনিমেষ ফিসফিস করে বলেছিল, এই জলহরির ওপারে যদি নাচঘর থাকত, যদি তোমার যুবক রাজা অজিত হতো তবে সোনার হুঁকোয় টান দিতে দিতে ডুব দিতাম জলসায়। যুবকের নাকে চিমটি কেটে মাধবী বলেছিল চরিত্রহীন তুমিও দুই রানি রাখতে? মনে রেখো মাধবীলতার কিন্তু আত্মমর্যাদা আছে। এরপরে সামন্ত রাজ থেকে অনিমেষ ডুব দিয়েছিল পুঁজিবাদ ও দারিদ্র ভাবনায়। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলেছিল, সম্ভ্রান্তরা হুঁকো টানত। আর্থ-সামাজিক দাঁড়িপাল্লায় তা কখনো সোনা কখনো রূপোর হতো। আর গরিব হলে নেশার চোটে টানতে হতো গড়গড়া। সুখটান একই থাকলেও সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী বদলে যায় তামাকের পাত্র। ধমক দিয়ে যুবতী বলেছিল এই যেমন তোমার সিগারেট আর বিড়ি! সারাক্ষণ শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া! ঠোঁটের হাল দেখেছ! সেদিন কালচে হয়ে যাওয়া রুক্ষ ঠোঁট দিয়ে গোধূলির সিঁদুর রাঙা মাধবীর ঠোঁটের ওপরে প্রতিশোধ নিয়েছিল অনিমেষ।

পারাং নদীর ধারে শিরোমণির সেনোটাফ খুঁজে পাওয়ার পর কেটে গিয়েছে প্রায় ২ বছর। কৃষ্ণচূড়া গাছটা বড় হয়েছে একটু। ওরা নিয়ম করে আসে এখানে। ইতিহাসের গন্ধে জমা হতে থাকে প্রেমের গল্পও। এভাবেই ওরা ছুটে চলে চুয়াড় বিদ্রোহস্থল কর্ণগড়-আবাসগড়-একের পর এক মহাফেজ খানা।

এক দুপুরে ভাত ঘুম ভাঙিয়ে অনিমেষকে ডাঁই করা ধুলো জমা নথির সামনে এনে বসিয়ে ছিল মাধবী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাতা উল্টে-ধুলো মেখে-চোখ লাল করে-হাঁচতে হাঁচতে ওরা পেয়েছিল সেই নথিটা। যা এতদিন পড়েছিল বইয়ের পাতায়। টানা ইংরেজি হরফে স্পষ্ট লেখা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রানি শিরোমণিকে ২৮টি বন্দুক, একটি সোনার হুঁকো ও একটি হাতি ফিরিয়ে দিয়েছিল। ফিচেল প্রেমিক মাধবীকে বলে ওঠে, হাতির প্রাণ এতদিন থাকবে না স্বাভাবিক কিন্তু বন্দুক আর হুঁকো গেল কই? হলদে হয়ে যাওয়া পাতায় চোখ রেখে চশমা ঠিক করতে করতে মাধবী বলেছিল, পরে ওসব গিয়েছিল নাড়াজোল রাজ পরিবারের কাছেই। যুবক প্রশ্ন ছোঁড়ে, আচ্ছা! রানি হুঁকো টানতেন? মাধবী চোখ তুলে বলে, ফেমিনিজিম আজকালকার মতো শো অফের ছিল না। নারী উত্থান কনসেপ্ট বহু প্রাচীন। মহিলা বলেই হুঁকো খেতে পারবেন না, তা নয়। তবে নেশাটা খারাপ। শিরোমণি কিন্তু বিখ্যাত তাঁর কাজের জন্য। আর রানিকে হুঁকো ফিরিয়ে দেওয়া মানেই এই নয় যে সেটা রানিই টানতেন, অজিত সিংহ বা তাঁর বাবা- যাঁর হোক এই নেশা থাকতেই পারে অথবা অতিথি আপ্যায়নের জন্য। রানিকে শুধু বাজেয়াপ্ত করা বিপুল জিনিসের মধ্যে এটুকু ফেরানো হয়েছিল। আর লুঠ হওয়ার হিসেব থাকে না। মাথা চুলকে মিচকে হাসি দিয়ে অনিমেষ বলল, এবার একটু হাওয়া লাগাতে বেরনো যাক। চা ছাড়া আর চলছে না। বাকি কাজ পরে হবে…

মাঝে মাঝেই প্রেমিকার বিভিন্ন নাম দেয় যুবক। মাধবীলতা এখন রানি পুরাতনী। সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। এখন বন্ধ। রানিকে নিয়ে এসে ভোরের আলোয় আবাসগড়ের পেছনে রাজার দিঘির ঘাটে বসল স্বপ্ন দেখার রাজা-সেই যুবক। কর্ণগড়ের রাজাদের গড় ছিল এখানেও। অস্তিত্ব আজও আছে। তবে কতদিন থাকবে তা চিন্তার। গ্রেফতারির পরে আদালতে হাজিরা দেওয়ার আগে এখানে বন্দি ছিলেন রানি। আবার দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পরে মুক্তি পেয়ে জীবনের শেষ সময়টুকু এখানেই অতিবাহিত করেছিলেন শিরোমণি। এই দিঘি তৈরির পেছনেও রয়েছে কর্ণগড়ের সিংহ বংশের হাত।

সব পুরুষের কাছেই তার প্রেমিকা রানি। হুকুম মাফিক চলতে হয়। যুবতীর ইচ্ছে স্নান করবে। বিদঘুটে ইচ্ছে তুঘলকি রানির নতুন কিছু নয়। এখানের ঘাটে অনেকেই স্নান করে। তবে এই পোশাকে? ভেজা কাপড়ে বাড়িতে গিয়ে কি বলবে? বোঝানো পর্ব চলছে। এমন সময় মেঘ ডাকল। রানি হেসে উঠল। যুবক স্থির। রানি আকাশের দিকে হাত তুলে মৃদু কণ্ঠে গেয়ে উঠল, ‘প্রাণ ঝরিয়ে তৃষা হরিয়ে…’ এ কী! একফোঁটা বৃষ্টি হলো যেন… রানি যুবকের দিকে তাকিয়ে হাসছে। স্বপ্নের রাজা সেই যুবক হেসে উঠল। রাজা থেকে হয়ে গেল দাস। ঘাটে দু সিঁড়ি নেমে রানির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, তানসেন বৃষ্টি নামাতেন, আর এই নামালে তুমি…

ছোট ছোট ডুব দিচ্ছে মাধবী। বলছে, অনেক অনেক বছর আগে সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্ত্রীরা প্রাণ খুলে স্নান করতে পারতেন না। দিঘিতে ডোবানো হতো পালকি… অনিমেষ ভয় পায় মাধবীর এই মুক্তির ছোট ছোট আনন্দকে। ওকে খুব সামলে রাখতে হয়। তাই সতর্ক। আরেকটু গেলেই দিঘি গভীর। দুর্ঘটনাও কম ঘটেনি এখানে।হাত ধরে ডুবছে উঠছে সেও। মাধবীকে বলল, এবার উঠতে হবে… রানি মানেই অবাধ্য।

কেটেছে আরও কিছুক্ষণ। আসতে আসতে ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে ওরা। বেশ অনেকটা চলে গিয়েছিল। এখন নিরাপদ দূরত্ব। যুবক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। নিজের মনেই ভাবল প্রতিবার এত প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। ঠিক তখনই ঝটকা লাগল যুবকের হাতে। মাধবী বাঁ দিকে নুইয়ে পড়ছে। উফফ্ বলে চিৎকার করে উঠল। অনিমেষ বোঝার চেষ্টা করল, মাধবীর হাত ধরেই ডুব দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। মাধবী বলল, পা আটকে গিয়েছে পাঁকে। অনিমেষ টান দিচ্ছে। সুবিধা হচ্ছে না। ভাবছে চিৎকার করবে। না সে সব কিছু করতে হয়নি। মাধবী নিজেই পা তুলছে। তবে পায়ে কী যেন জড়িয়ে বেশ ভারী, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। অনিমেষকে বলতেই সে শিউরে উঠল। ভাবছে সাপ! পাগলের মত চিৎকার করছে যুবক। বৃষ্টিতে বাইরে নেই কেউ। ক’জন শুনতে পাচ্ছে কে জানে! যুবক মাধবীর হাত ধরেই ডুব দিল পায়ের কাছে। হাতে চেপে ধরল। লিকলিকে- শীতল- কাদামাখা। প্রাণের ভয় ছেড়ে টান দিল এক ঝটকায়। ভারী। ছুঁড়ে ফেলল ঘাটের দিকে। মাধবী গোঙাচ্ছে। পা ক্ষতবিক্ষত বোঝাই যাচ্ছে। কোনও রকমে ঘাটের সিঁড়িতে যুবতীকে টেনে আনল অনিমেষ। মাধবীর মুখ শুকিয়ে গেছে। অনিমেষ ভালো করে দেখার চেষ্টা করছে পায়ে ছোবলের দাগ আছে কিনা। বুঝতে পারছে না। হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে। ততক্ষণে ছুটে এসেছে বেশ কয়েকজন। স্থানীয়রা দেখে কেউ বলছে সাপ, কেউ বলছে সাপ নয়। ঘাটের ধাপেই ঢলে পড়ল মাধবী। আবার কঁকিয়ে উঠল। শরীর পড়েছে শক্ত এবড়ো খেবড়ো কিছু ওপর। যুবকের আর্তনাদ। বৃষ্টির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কান্নার জল। মাধবীকে সোজা করে শোয়াতে গিয়ে সরাল কাদামাখা জিনিসটা।

স্থানীয়রা ধরে এনেছে ডাক্তার। তিনি ভাল করে দেখে বললেন, সাপের ছোবল নয়। পায়ে আটকে ছিল অন্য কিছু। আঘাত পেয়েছে। ফাস্টএইড দিলেন। বললেন, এক্সরে করিয়ে নিতে। ঘাটে ততক্ষণে লোক বেড়েছে আরও। জেরা চলছে, কোথায় থাকো? এত ভোরে কী করছিলে? কেন নেমেছিলে? সাফাই দিতে হচ্ছে। ওদের ইঙ্গিত করে উঠে আসছে চটুল কথাবার্তাও। ধীরে ধীরে উঠে যুবকের গায়ে ঠেস দিয়ে আছে ক্লান্ত যুবতী।

ওরা উঠতে যাবে এমন সময় মাধবী প্রশ্ন করে ওটা কী? যুবক তাকিয়ে দেখে, সিঁড়ির ধাপে লম্বা তামার মোটা নলের মত কিছু। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে লেগে থাকা কাদা। সে বলে, তাহলে এটাই যত নষ্টের গোড়া! কাছে গিয়ে টান মারতেই বোঝা গেল আরও কয়েকধাপ নিচে আটকে আছে ভারী কিছুতে। উঠে এলো সহজেই। তামার লম্বা কিছুতে আটকানো। জড়িয়ে আছে কচুরিপানা আর কাদা। ভালো করে দেখতে বোঝা গেল তামার হুঁকো। মাটির নিচে চাপা পড়েছিল। কোনও কারণে মাটি আলগা হতে উঠে এসেছে। তামা নাকি আসলে সোনা? চমকে উঠল যুবক। নিয়ে এল মাধবীর কাছে। ব্যথা চোখে মাধবী দেখল। তাকিয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। চোখের ইশারায় কথা হয়ে গেছে দু’জনের। উঁকি মারছে লোকজনও। নুয়ে থাকা যুবকের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে এসে মাধবী বলল, রাজার দিঘিতে রানির হুঁকো নয় তো? সেই সোনার হুঁকো? এই জায়গা-দিঘি তো তাঁদেরই ছিল! চোখে-ঠোঁটে রহস্যের ঝিলিক।

এর মাঝে শুরু হয়েছে এলাকাবাসীর জল্পনা। মিশে আছে ধূর্ত লোকও। বহু দাবিদার! মাঝে মাঝে গরম হুমকি ধেয়ে আসছে দুজনের দিকে। দিতে হচ্ছে কৈফিয়ৎ। পরিস্থিতি বুঝে যুবক ফোন করল থানায়। নিমেষে বদলে গেল পরিস্থিতি। মাধবী হাত টিপে বলল, আগে রিপোর্টারদের খবর দাও। মিউজিয়ামে পাঠাতে হবে। তারপর বাকি সবকিছু। ফিচেল যুবক বলে উঠল, একটা টান দেবো না? হেসে উঠল দুজনেই। এখন অপেক্ষা…

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By নিসর্গ নির্যাস মাহাতো

শখ: লেখালেখি। প্রকাশিত বই: ভেঙে যায় চৌকাঠ দেশ ও বাড়ি, কর্ণগড়ের মর্যাদা। সম্পাদক: ম্যাগাজিন।

Leave a Reply