[প্রথম পর্ব]

জুলাই মাসের উত্তপ্ত দুপুর। মেঘলা আকাশের নিচে পুরী রথযাত্রার প্রস্তুতি চলছে, কিন্তু আমরা সেই পুরীর কথা বলছি না। এ গল্প পুরুলিয়ার এক অখ্যাত গ্রাম—গুড়িপাড়া—নিয়ে। এখানে রথযাত্রা হয় ঠিকই, কিন্তু রথটা কাঠের নয়, লোহার নয়, স্বপ্নের তৈরি।

মাঝবয়সী মিস্ত্রি নিত্যানন্দ হাঁপাতে হাঁপাতে রথের চাকা ঘষছেন। ঘর্মাক্ত মুখে চাপা এক উত্তেজনা। এই রথ তিনি গড়েছেন একাই—পুরো ছ’মাসের পরিশ্রমের ফল। রথের কাঠামো কাঠের হলেও তার হৃদয় পিতলের মতো জ্বলজ্বলে।

গ্রামের লোকজন বলছে, “এই বছর নিত্যানন্দর রথটাই সেরা হবে। পঞ্চায়েতও তো বলেছে, ওটাই যাবে মেলা ময়দানে!”

কিন্তু সবার চোখে এক অদৃশ্য প্রশ্ন ঝুলছে—নিত্যানন্দের স্বপ্ন কি এবারো ভেঙে পড়বে?

নিত্যানন্দের ছেলে অভির বয়স উনিশ। গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় পড়তে গিয়েছিল, কিন্তু ফিরে এসেছে ল্যাজ গুটিয়ে। কলেজে সিট হয়নি, চাকরির জন্যে যে আবেদন করেছিল, সেখানেও ডাক আসেনি। এখন সে রিকশা চালায়—গ্রামের বাইরের রাস্তায়।

রথের কাজ দেখে সে বলে, “বাবা, তুমি এত খাটছো, কিন্তু কি হবে এসব করে? মানুষ এখন টিকটক দেখে, রথ নয়।”

নিত্যানন্দ চুপ। মাথা নিচু করে চাকা ঘষতেই থাকে। অভি চলে যায়, পেছনে ফেলে যায় এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

গ্রামে এখন রাজনীতি জোরদার। সদ্য নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রধান রতন মণ্ডল চায় রথকে ‘লোকোৎসব’-এর অংশ করতে—তার দলে যে নতুন উঠতি যুবকরা আছে, তাদের প্রচার হবে, পোস্টার হবে, লাউডস্পিকার বাজবে।

নিত্যানন্দের স্বপ্ন অন্যরকম—সে চায় এই রথ হয়ে উঠুক গ্রামবাসীর গর্ব, শহরের মানুষ এসে দেখুক, গাঁয়ে এখনো সৃষ্টি হয়, এখনো হাতে তৈরি শিল্প টিকে আছে।

রতনের লোকজন আসে একদিন—”কাকা, একটু নাম লেখান, আপনার রথে আমাদের ব্যানার দেবো। আরেকটা কথা, এই বছর সরকারি টাকায় সাউন্ড সিস্টেম বসাবো রথে।”

নিত্যানন্দ তীব্র কণ্ঠে বলে, “আমার রথে বাণিজ্য নয়। আমার রথ চলবে বিশ্বাসে।”

লোকগুলো হেসে চলে যায়—”বুঝবেন কাকা, এই যুগে বিশ্বাসে রথ চলে না।”

রথযাত্রার দিন এগিয়ে আসে। মাঠ পরিষ্কার হচ্ছে, মাইক বসছে, হাট বসছে। কিন্তু সেই রাতেই ঘটে দুর্ঘটনা। ভোরে উঠে দেখা যায়—নিত্যানন্দের রথ ভেঙে পড়ে আছে। চারটি চাকা আলাদা, শাখামুখ ভেঙে গুঁড়ো।

অভি ছুটে আসে—”কে করল এটা?”

কেউ কিছু দেখেনি। গ্রামের লোকজন নীরব। কেবল বাতাসে একটা গুঞ্জন—”নিত্যানন্দ পাগল হয়েছে। নিজের রথ নিজেই ভেঙেছে। ও চায় না, কেউ তার রথে হাত দিক।”

নিত্যানন্দ কাঁদে না। কিছু বলে না। কেবল বসে থাকে ভাঙা রথের পাশে, পাথরের মতো।

অভি রাতে চুপিচুপি কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে যায়। তারা রথের ভাঙা অংশ জোড়া লাগাতে শুরু করে। হাতে হাত রাখে গ্রামের কিছু তরুণ—যারা বিশ্বাস করে, ভাঙা জিনিসও গড়ে ওঠে।

তিনদিনের মাথায় এক নতুন রথ দাঁড়ায়। পুরনোর চাইতে ছোট, কিন্তু অনেক বেশি মজবুত।

নিত্যানন্দ তখন চুপচাপ এক কোণে বসে, চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি।

রথযাত্রার দিন। গ্রামের মাঠে দুইটি রথ—একটি সরকারি মঞ্চে, বিশাল ডিজিটাল ব্যানার লাগানো, প্রচারের ঢক্কানিনাদে ভারী। আরেকটি রথ—মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে, একদল ছেলেমেয়ের হাতে গড়া, সাদামাটা অথচ প্রাণবন্ত।

মানুষ প্রথমে যায় পঞ্চায়েতের রথ দেখতে। ছবি তোলে, ভিডিও করে। কিন্তু হঠাৎই মাইক বিকল হয়, ডিজেল শেষ, যন্ত্রপাতি বিগড়ে যায়।

এদিকে অভি হেঁটে রশি টেনে তার বাবার তৈরি রথ চালিয়ে নিয়ে চলে মেলার মাঠে। ছেলেমেয়েরা গলা মিলিয়ে গায়—
“জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা যাত্রা করে
লোকের মনে রথে চড়ে…”

মাঠ জুড়ে লোক জমে যায়। মানুষ ফিরে আসে সেই রথের কাছে, যে রথে স্বপ্ন ছিল, শ্রম ছিল, ভালবাসা ছিল।

রথের শেষে পঞ্চায়েত প্রধান আসে। নিত্যানন্দের সামনে দাঁড়ায়। একটু ইতস্তত করে বলে—”কাকা, আমরা ভুল করেছি। আপনি চাইলে আপনার রথকে সরকারি মডেল হিসেবে পাঠাবো রাজ্য পর্যায়ে।”

নিত্যানন্দ মৃদু হাসে। বলে, “আমার রথ যেখানে মানুষের হাত ছুঁয়েছে, সেখানেই ওর গন্তব্য ঠিক হয়েছে। আর কোনো ব্যানারের প্রয়োজন নেই।”

পাশে অভি দাঁড়িয়ে। তার চোখে আজ প্রথমবার একটা দৃঢ়তা—যেন সে বুঝেছে, রথ শুধু কাঠের নয়, রথ মানে একটা চলমান স্বপ্ন, যা ভেঙে পড়েও আবার উঠে দাঁড়াতে জানে।

[দ্বিতীয় পর্ব]

রথযাত্রা পেরিয়ে গেছে পাঁচদিন। মেলার মাঠ এখন ফাঁকা, পোস্টার খুলে ফেলা হয়েছে, লাইট-সাউন্ড গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। কেবল রথটা দাঁড়িয়ে আছে মাঠের কোণে—নিত্যানন্দের রথ, অভির হাতে টানা, জনতার ভালোবাসায় গড়া।

গ্রামের ছেলেরা বলছে, “এবার আমরা নিজেরাই উৎসব করব। রথ শুধু একদিন নয়, সারাবছর চলুক আমাদের মাঝে।”

অভি এবার এগিয়ে আসে। সে বলে, “এই রথটা এখন একটা পাঠশালা হোক। গ্রামের বাচ্চারা এখানে আঁকবে, গাইবে, শেখাবে। বাবার হাতে গড়া কাঠের ভেতরে থাকবে ভবিষ্যৎ গড়ার শিক্ষা।”

লোকজন চমকে যায়। কেউ হাসে, কেউ ভাবে—এই ছেলে কি পাগল?

কিন্তু কিছু লোক এগিয়ে আসে—দুইজন শিক্ষক, একজন পুরনো লাইব্রেরিয়ান, আর একজন বাউল গায়ক। তারা বলে, “তুই এগিয়ে যা, অভি। তোর বাবার হাতের রথই আমাদের নতুন আশ্রয় হোক।”

পঞ্চায়েত আবার নড়েচড়ে বসে। রতন মণ্ডল জানে, যদি এই ‘রথ পাঠশালা’ জনপ্রিয় হয়ে যায়, তবে তার ‘সংস্কৃতি উন্নয়ন প্রকল্প’ মুখ থুবড়ে পড়বে।

তিনি একদিন গোপনে ডাকে অভিকে—”শোনো, তোর বাবার রথকে আমরা স্থায়ী সংগ্রহশালায় রূপান্তর করতে চাই। কলকাতা থেকে মিউজিয়াম করবো, তোর নামও থাকবে, বাবার মূর্তিও হবে।”

অভি জিজ্ঞেস করে, “আর আমাদের বাচ্চারা? যাদের এই রথ স্কুল?”

রতন মৃদু হেসে বলে, “তাদের জন্য নতুন স্কুল হবে। সরকারি প্ল্যান। সাদা দেওয়াল, খোলা মাঠ, কিন্তু তা সময় নেবে। রথটা আগে তুলে নেওয়া দরকার।”

অভি বলে না কিছু। শুধু মাথা নিচু করে চলে যায়। তার মনে পড়ে যায়—ভাঙা রথ, বাবার হাত, ভাঙা স্বপ্ন আবার জোড়া লাগানোর সেই রাত।

অভি এবার সিদ্ধান্ত নেয়। সে শহরে যায়, তার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে। তারা কেউ এখন স্টার্টআপে কাজ করে, কেউ NGO-তে। অভি বলে, “আমাদের গ্রামে একটা রথ আছে, যা স্কুল হতে চায়। আমাদের দরকার কিছু পেইন্ট, কিছু বই, কিছু ছবি, আর ভালোবাসা।”

বন্ধুরা ভাবে, হাসে, তারপর বলে—”তুই ঠিক বলছিস, রে। তোকে নিয়ে আবার গর্ব হচ্ছে।”

এক সপ্তাহের মাথায় গুড়িপাড়ায় আসে রঙ, গল্পের বই, প্ল্যাকার্ড, সাদা কাপড়, ছেলেমেয়েদের খেলার জিনিস। অভি, তার বন্ধু, আর গ্রামের তরুণেরা একসঙ্গে বসে রথের কাঠে আঁকে পদ্ম, চাকা, পাখি, শিশুদের মুখ।

নিত্যানন্দ সেই সময় বিছানায় পড়ে গেছেন। শরীরে বল নেই, কিন্তু মুখে আলো।

তিনি অভিকে ডেকে বলেন, “তুই যা করছিস, তা আমার রথকেও নতুন জীবন দিচ্ছে। জানিস, আমি ছোটবেলায় যখন রথে উঠতাম, ভেবেছিলাম, আমি একদিন নিজেই রথ গড়বো। কিন্তু তোর মতো করে ভাবিনি। তুই আমার থেকেও অনেক বেশি গড়ছিস, রে।”

অভি বাবার হাত চেপে ধরে। বলে, “তুমি রথ গড়েছো, আমি শুধু তাকে ঠেলছি।”

শরৎকালে রথ পাঠশালার প্রথম শ্রেণি বসে। ১৪ জন শিশু, পাটের চটের ওপর বসে গল্প শুনছে—”মলয়া পর্বতের ওপারে এক রাজা ছিলেন…” অভি গল্প বলছে, পাশে বসে আছে তার মা, আর বাউল কাকা তানপুরা বাজাচ্ছে।

সেইদিন সন্ধ্যায় পঞ্চায়েত আবার আসে, কিছু মিডিয়া কর্মী নিয়ে। তারা ছবি তোলে, ভিডিও করে। এবার আর বাধা দেওয়ার সাহস হয় না।

রতন মণ্ডল দাঁড়িয়ে থেকে বলে, “এই উদ্যোগ গ্রামকে নতুন পরিচয় দিয়েছে। আমরা চাই, এই রথ সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ুক।”

অভি বলে, “এই রথ কোনো পার্টির নয়, কোনো সরকারের নয়। এটা গড়েছে মানুষ, চালিয়েছে বিশ্বাস। এটা কোনো ‘ব্র্যান্ড’ নয়, এটা হচ্ছে একটা বাতিঘর।”

দুই বছর কেটে যায়। রথ পাঠশালা এখন এলাকার সেরা অলটারনেট স্কুল হিসেবে পরিচিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অধ্যাপক গবেষণা করছেন এই প্রয়াস নিয়ে।

অভি এখন মাসে একবার শহরে যায়, বাচ্চাদের জন্য বই আনে, অতিথি শিক্ষক নিয়ে আসে। তার হাতের রিকশার চাকাও আজ বিশ্রামে।

নিত্যানন্দ এখন চোখে ভালো দেখতে পান না, কিন্তু তিনি রোজ রথের নিচে বসে থাকেন। শিশুদের চিৎকার শুনে বলেন, “এই শব্দটাই আমার রথের চলার শব্দ।”

একদিন বৃষ্টি নামে, তীব্র বর্ষা। মাঠ ভিজে যায়, পাটের চট নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু অভি আর তার দল রাতেই প্লাস্টিক ঢাকে, ছাতা খাটায়, শিশুদের ঘরে নিয়ে পড়ায়।

সেই রাতেই নিত্যানন্দ ঘুমিয়ে পড়েন—শেষবারের মতো। সকালে তার নিথর দেহ পাওয়া যায় রথের চাকার পাশে, মুখে প্রশান্তি।

গ্রাম শোক করে না। তারা গান গায়। তারা জানে, একজন কারিগর চলে গেছেন, কিন্তু তার রথ চলতেই থাকবে।

আজ গুড়িপাড়ার মেলায় দুইটি রথ থাকে—একটি ডিজিটাল, আলোকময়, এবং একটিকে বলা হয় “মানব রথ”।

মানুষ আগে ছবি তোলে প্রথমটায়, কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ায় দ্বিতীয়টির সামনে। কাঁচা হাতে আঁকা পদ্মের ছবি, কাগজের ফুল, আর শিশুদের হাতের ছোঁয়া মানুষকে থমকে দেয়।

একজন শহুরে সাংবাদিক একবার জিজ্ঞেস করেছিল অভিকে—
“আপনার কাছে রথ মানে কী?”

অভি বলেছিল,
“রথ মানে শুধু মূর্তি তোলার কাঠামো নয়, রথ মানে—যা একটা সমাজকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখায়। আমার বাবা সেই রথ গড়েছিলেন, আমরা এখন তাকে টানি একসঙ্গে।”

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By ঋদ্ধি সাহা

জন্ম ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০০২, নৈহাটি শহরে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা ও চর্চা। স্নাতক রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির, বেলুড় থেকে। স্নাতকোত্তর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ, ভালোবাসা। মিশন স্কুলে থাকাকালীন বিজ্ঞান ছেড়ে কলেজে উঠে সাহিত্য নিয়ে পঠনপাঠন ও পাশাপাশি লেখালেখির শুরু। বেশ কিছু পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত। ভালোলাগা - ফুটবল, লেখালেখি, সিনেমা।

Leave a Reply