মৃত্যু চেতনার নিপুণ সাঁতারে জন্মদাগ: আমাদের অ্যানিমিক বাংলা কবিতার ক্ষতে প্রলেপ

অভীক মজুমদার, আমার মাস্টারমশাইয়ের নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘খিদে হাতে হেঁটেছি অনেক’। তুমি- আমির প্রতিকৃতি ছাড়িয়ে যখন শব্দ এসে মিশে বোধে, সত্তায়; তখনই মনে হয় সৃষ্টি করা যায় এমন অমোঘ কিছু কথামালার,

‘মনে হয় তুমি- আমি- সে যখন ব্যর্থ হবে, তখন সীমান্ত শুরু’

সীমান্তে, বারুদ গন্ধে, হলুদ পাতার স্তুপে ভেসে আসে নিজের সাথে সংলাপে মত্ত কবির স্বর। বারবার যেন ফিরে ফিরে আসে ডাক্তারের রূপক, সে পরীক্ষা করে কবিকে কিন্তু কবির পরীক্ষা তো ছন্দে, শব্দে,যতিতে, নগর দরিয়ায় তাই অপার্থিব জাপ্টে থাকা শহরের খাঁজে খাঁজে তিনি শুনতে পান,

‘একটু শাঁখ। ঘন্টা। আজান। রেডিও।’

আর ডাক্তারবাবু যেন বারংবার সরিয়ে আনতে চান তাকে, তবু কবি বলে ওঠেন অলক্ষে,

‘হ্যালুসিনেশন, আমি বলেছি তো এক অনবদ্য শিল্পস্বরূপ।’

পার হয়ে যায় নগরদরিয়া, তবেই তো মনে আসে ‘এক পলক খণ্ডকাল অনন্ত’, ‘যাজকের ছদ্মবেশে কয়েকজন অপরাধী’, উড়ো খই-চলে যাওয়া মুক্তিবোধই মনের দৃশ্যপট এঁকে নেয় ক্লাসঘর হুয়ান রুলফোর পেড্রো পারামো, ভুতুড়ে স্মৃতিশহর কোমালা আর যাজকের দল।

শহরের চেতনা, সমকাল ভিড় করে এসে বসে কবির চারিপাশে, ছাদে কিংবা চিলেকোঠার খোয়াবে আর তিস্তা নামের মেয়েটির দশমীর দিন বিসর্জনের শোভাযাত্রা থেকেই তাঁর পাশে বসে দেখে,

“মৃত, বিস্মৃত, নিহত, জীবিত
সহস্র কোটি নারী দলে দলে… যেন ধিক্কার
অমাবস্যার আকাশে চলেছে রাত্রি দখলে”

তার কথায় মৃত্যু, ফের মাথা তোলে আর ফিরে ফিরে আসে প্যালেস্তিনের শিশু, রোহিঙ্গা মিছিল, জবাবে নিথর শিশুর ফেলে দেওয়া খেলনা, গান ঠিক যেন ‘গ্রিক যোদ্ধাদের সামনে নিরস্ত্র শ্রমণ’, স্তব্ধ হয়ে যায় এই পাঠকমন নিরস্ত্র কবির স্তোত্রপাঠে। তবু ‘ভয় ভয় ভয়’, তাড়া করে ধুলোখুকিকে, কবির পাশাপাশি তিনি তো শিক্ষক, বাবা, অভিভাবক তাই তিনি হয়তো সব বাধা পেরিয়ে পেরিয়ে অন্যায়ের চোখে চোখ রেখে বলে দিতে পারেন অনায়াসে,
“এই শিল্প শিল্প চুল্লি শিল্পপণ্য শিল্প বিভীষিকা”।

তাই সচেতনে- অবচেতনে যে কবিতা, গান, পদ এসে ভিড় করে পাঠের মাঝে, ঠিক যেমন হাঁটতে হাঁটতে ভাবার সময় ঘটে কবির, তেমন ভাবেই এখানে মিশে যায় কবির অভিপ্রায় এবং পাঠকের দৃশ্যপটে ভেসে আসা গঙ্গাজল কিংবা স্থির চিত্তে জলের পাশে থাকা মুন্ডহীন দেবী মূর্তি। এইসব অযুত স্মৃতি, গান তুকারাম- মীরার কাছে জমে থাকা ঋণ সবই মনে করিয়ে দেয় বারবার ‘কবি’ কথাটির আরেক নামই তো ‘পথিক’। তাই বারংবার জীবন ভর বলতে চাই,
“হে শিক্ষক/ দীক্ষা দাও/ পাগলামির/ ঘরছাড়ার”

ভেসে আসা আজানের মতো সুর, ঘুরে বেড়ায় কবির খোয়াব জুড়ে, শঙ্খ ধ্বনির পরেও তিনি ফর্ম, গ্রামারের মাঝে কি করে মিশিয়ে দিতে পারেন কুমোরটুলি প্রতিমা শিল্পীর দলকে? এই কাঠামো ফর্ম- এই কাদামাটির ব্যাকরণ যেন ফিরে আসে তাঁর প্রতি লেখায়, খোয়াব জুড়ে শঙ্খ ধ্বনির পরেও লেখায় নিজের সত্তাকে, ভেঙে ঠিক যেমন তিনি শুরু করেছিলেন ‘আগুনের রোয়াবে’।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By রাজসী বসু কুন্ডু

অক্ষর আর আকাশ কুসুম স্বপ্ন বুনেই লিখতে ভালোবাসে। প্রকাশিত বই- মীরার গান, বিষণ্ণতার ছবি।

Leave a Reply