শ্রীলঙ্কার সিনেমার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত সুমিত্রা পেরেরের ১৯৭৮ সালের সিনহালা চলচ্চিত্র ‘গেহেনু লামাই’ (কন্যাশিশুরা) এই বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুনরুদ্ধারিত সংস্করণে বিশ্ব প্রিমিয়ারের আয়োজন করতে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের ১৭ মে, শনিবার বিকাল ৪টায় ফ্রান্সের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রাসাদ পালাই দে ফেস্টিভাল-এর সালে বুনুয়েল-এ এই বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। চলচ্চিত্রটির মূল অভিনেতা-অভিনেত্রী বাসন্তী চতুরানী, অজিত জিনাদাস এবং শ্যামা আনন্দের উপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান আরও ঐতিহাসিক মাত্রা পাবে। চলচ্চিত্রটি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে FISCH (ফ্রান্স-ইন্ডিয়া-শ্রীলঙ্কা সিনে হেরিটেজ) প্রকল্পের অধীনে, যা চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য রক্ষায় ফ্রান্স, ভারত ও শ্রীলঙ্কার যৌথ উদ্যোগ।
‘গেহেনু লামাই’ শ্রীলঙ্কার গ্রামীণ সমাজের পটভূমিতে আবর্তিত হয়, যেখানে দুটি কিশোরীর জীবনসংগ্রাম ও স্বপ্নের গল্প বলা হয়েছে। মূল চরিত্রগুলি সমাজের নিপীড়ন, দারিদ্র্য ও পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াই করে। একজন কিশোরী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়, অন্যজন যৌন নিগ্রহের শিকার হয়ে পরিবার ও সমাজের বিচারে নিষ্পেষিত হয়। তাদের সহজ-সরল স্বপ্ন, মানবিক আবেদন এবং অদম্য প্রতিবাদ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় বিষয়। সুমিত্রা পেরেরের নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে নারীর আত্মপরিচয়ের সন্ধান, সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নীরব বিদ্রোহ এবং মানবিক সম্পর্কের জটিলতা। এটি কেবল একটি চলচ্চিত্র নয়, এক যুগের সমাজচিত্র।
‘গেহেনু লামাই’ শ্রীলঙ্কার সিনেমা জগতে সুমিত্রা পেরেরের স্বতন্ত্র পরিচালনাশৈলীর অনন্য উদাহরণ। ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি সমাজের প্রান্তিক কন্যাশিশুদের জীবনসংগ্রাম, নৈতিক দ্বন্দ্ব এবং নারীস্বাধীনতার জটিল প্রশ্নগুলোকে অন্তরঙ্গভাবে তুলে ধরে। শ্রীলঙ্কার গ্রামীণ সমাজের পটভূমিতে নির্মিত এই চলচ্চিত্র শুধু দেশের সীমানা ছাড়িয়েই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমাদৃত হয়েছিল। সুমিত্রা পেরের, শ্রীলঙ্কার প্রথম নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে খ্যাত, তার সিনেমায় মানবিক আবেদন এবং নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ‘গেহেনু লামাই’ তার সৃষ্টিশীলতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এই চলচ্চিত্রের পুনরুদ্ধার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে FISCH (France-India-Sri Lanka Cine Heritage) নামক একটি যুগান্তকারী আন্তর্জাতিক প্রকল্পের মাধ্যমে। এই উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে মুম্বাইভিত্তিক Film Heritage Foundation, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ফ্রান্সের দূতাবাস (Ambassade de France en Inde এবং Ambassade de France à Sri Lanka et aux Maldives), এবং French Institute in India। FISCH-এর মূল লক্ষ্য হলো এশিয়ার চলচ্চিত্র ঐতিহ্যকে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা। এটি কেবল একটি চলচ্চিত্রই নয়, একটি সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন তৈরি করছে—যেখানে ফ্রান্সের প্রযুক্তিগত দক্ষতা, ভারতের সংরক্ষণ অভিজ্ঞতা এবং শ্রীলঙ্কার শৈল্পিক উত্তরাধিকার একত্রিত হয়েছে।
চলচ্চিত্রটি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি, যা ফিল্মের ক্ষয়িষ্ণু প্রিন্টকে উচ্চ রেজোলিউশনের ৪কে ফরম্যাটে রূপান্তর করেছে। শব্দ ও চিত্রের মানোন্নয়নে কাজ করেছেন বিশেষজ্ঞরা, যাতে মূল চলচ্চিত্রের শৈল্পিক সততা বজায় থাকে। এই প্রকল্পের সাফল্য শুধু ‘গেহেনু লামাই’কেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার হারিয়ে যাওয়া সিনেমাটিক ধারাকে পুনরুদ্ধারের আশাও জাগিয়েছে।
কান চলচ্চিত্র উৎসব বিশ্বব্যাপী শিল্পসিনেমার মন্দির হিসেবে পরিচিত। সেখানে ‘গেহেনু লামাই’-এর প্রদর্শনী শ্রীলঙ্কার সিনেমাকে বৈশ্বিক পর্যায়ে পুনরায় উপস্থাপনের একটি সুযোগ। ১৯৭৮ সালের পর এই প্রথম চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক দর্শকদের সামনে আসছে পুনরুদ্ধারিত রূপে। পরিচালক সুমিত্রা পেরেরের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চলচ্চিত্রের সময়াতিক্রমী বিষয়বস্তু আজও প্রাসঙ্গিক—যা কানের মতো মঞ্চে নতুন প্রজন্মের দর্শক-সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন চলচ্চিত্রের মূল অভিনেত্রী বাসন্তী চতুরানী, যিনি শ্রীলঙ্কার সিনেমায় একজন কিংবদন্তি নাম। তার সঙ্গে থাকবেন অজিত জিনাদাস এবং শ্যামা আনন্দ। তাদের উপস্থিতি এই অনুষ্ঠানকে নস্টালজিয়া ও সম্মানের আবেশে ভরিয়ে তুলবে। উল্লেখ্য, এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই বাসন্তী চতুরানী দক্ষিণ এশিয়ার চলচ্চিত্র অঙ্গনে আলোচনায় আসেন।