কিশোর বর্মণের গুচ্ছ কবিতা

বুক পকেট ভর্তি লজ্জা নিয়ে হাঁটছি

 

অমিয় দা মুখোমুখি হলে

এই রাস্তার মোড়ে দাঁড়ালে কী দেখতে পান? ( চরিত্রটি উত্তর দেয় )
প্রচুর মানুষের হেঁটে যাওয়া ধুলোয় বৃদ্ধ হয়ে ওঠা গাছগুলো
তীব্রভাবে পৃথিবীকে বাঁচাতে চাইছে!
সাংসদ ভবন থেকে পঞ্চায়েত গ্রাম, এইসব রাস্তাগুলো হেঁটে যায়
হাঁটবেন নাকি?
ক্ষুদিরাম চৌপথী
নাম পালটে ‘ভাষণ সরণি’ রাখা উচিত নয়?

একটি দিনকে কীভাবে দেখেন? ( চরিত্রটি নড়ে এবং উত্তর দেয় )
সন্ধ্যা : অ্যালকোহল
নিসার রাত্রি : বিষ
শেষ অন্ধকার : অ্যাসিড
সকাল : খুন।

আর বিবৃতি কিছু আছে ?
‘অবশ্যই!’ ভাষণ ভঙ্গিতে চরিত্রটি উঠে দাঁড়ায়। যেন সামনে গিজগিজ অসংখ্য মাথা।

বিবৃতি– ১

যে পাখি গুলো পৃথিবী শাসন করতে চেয়ে অধিবেশনের জন্য কোনোদিন সময় নির্ধারণ করেনি
যে মানুষ গুলো শুধু বেঁচে থাকবে বলে মিছিলে পা মেলায়নি
যে জড়োসড়ো বৃদ্ধা তার প্রেমিককে ভুলে যায়নি
তাদের কোনো অভিধান নেই, রাষ্ট্রের।

বিবৃতি– ২

যারা এতদিন নাটক করে এলো
মাঝখানের বিরতিতে তাদের বিবেক ধ্বসে পড়ে ?
মানসিক রোগীর মতো তাদের উল্লাস
হিসেব আছে কার বুক থেকে কত স্বপ্ন কেড়ে নিল ?

বিবৃতি– ৩

যে সন্ধিগুলো শিলান্যাসের পর মুখ তুলে দেখেনি
তাদের জন্ম দিতে গিয়ে
দলছুট বুনো হাতির মতো পৃথিবীকে আমরা শাসন করতে চাই
হিংজালের বর্ণমালা দিয়ে।

 

বিবৃতি ওরফে একটি দিনের প্রতিবেদন

পাঁচটা সাতচল্লিশ
এক কাপ লাল চা ফু দিতে দিতে
পৃথিবীর ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো দেহটার পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে নিয়ে
খবরের কাগজ দেওয়া ছেলেটাকে মাসিক টাকা দিয়ে দিলাম।

নটা পঞ্চাশ
সাগর দীঘির মোড়ে প্রচণ্ড ভীড়
মানবাধিকার কর্মীরা আজকাল খুব উঠে পরে লেগেছে মৃত্যুদণ্ড রদ করতে হবে
বাবাকে চেকাপ করাতে নিয়ে যাই ভীড় ঠেলে

দুপুর বারোটা
অপেক্ষা করছি লাইব্রেরী মোড়ে
প্রেমিকা আসবে
দুপুরের নিষ্পৃহ শহর দাউ দাউ করে জ্বলছে
এখানকার আকাশে তখন পাখি নেই

তিনটে নাগাদ
তাঁর ছিড়ে যাওয়া গিটারটি ঠিক হলে
বড়বাজারের মার্কেট থেকে ফিরি বাসস্থানে

রাত দশটা
আর এক কাপ লাল চা
এবং কবিতাকে এজন্যই ভালোবাসি
এক বোতল ঠাণ্ডা জল টেবিলে, কাটা-ছেড়া হাতের লেখা
ডায়ারিতে মুখ উবু করে আমাকে ঠিক ঘুমিয়ে নেবে

রাত বারোটার দু-তিন মিনিট আগে
যখন ভারত পাকিস্থানের সীমান্তে গোলাগুলি হয়
কবিতা আমাকে তখন নিঃশব্দে ঘুম পাড়ায়…

বুক পকেট ভর্তি লজ্জা

বুক পকেট ভর্তি লজ্জা নিয়ে হাঁটছি
ন্যাংটো ছেলেদের রাস্তায় বোতল কুড়োনো উপন্যাস
দোকানে হানা দেওয়া স্বভাবের কুকুরটি
একটু আগে ত্রিতল থেকে পড়া শ্রমিকটির দোমড়ানো মোচড়ানো শরীর
বেকারের যে মিছিল একগুচ্ছ দাবী পেশ করল গিয়ে বিধানসভা ভবনে…

পকেটে তাদের চিঠি।

জমজমাট রাজপথ
কেউ চিঠি নিতে চায়নি, কেউ থামেনি, কেউ ঈষৎ ফিরিয়ে দেখেনি
দিনগুলোর ক্যান্সার রোগীর মতো মৃত্যু হয়।

আমাদের সাগর দীঘির সিড়িতে এক মানুষ বসতেন
রোজ নিজের মনেই লিখতেন কী সব ছেড়া কাগজের বাণ্ডিলে
পাগল, পাগল বলে সবাই তাকে।

আমিও দুপুর হলে, রাত হলে এই সিড়িতে বসেই দেখতাম
পাশের চার-পাঁচ তলা সরকারি ভবনগুলোর মনোরম ছায়া, জলে
অথবা রাত শহরের সিটিজেনদের আড্ডা
দেখতাম এক ঝাকরা চুলের মানুষ চেয়ে নেওয়া পাউরুটি খেতে খেতে কিসব লিখছে

চিঠি গুলো মিলিয়ে নেই এখানেই
অথচ কথা বলা হয়নি কখনো একে-অপরে

তারপর একদিন যেদিন খুব হই হট্টগোল হয়ে গেল
গুলিতে মারা গেল মিছিলের ক’জন
শহর শুনশান।

অতর্কিত মানুষটির প্রশ্ন আসে কানে– কবিতা লেখেন?
বলি। না কবি নই। কবিতা লেখিনা।
তোমাকে কি কেউ চিঠি পাঠাবার কথা আছে?
তাহলে বুক পকেটে একবার হাত বুলিয়ে দেখতে পারি : আমি চিঠি দেই।
আপনি বুঝি…?

অনুত্তরে হেসে ওঠে মানুষটি
উত্তরে আবার লেখায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন
বলেন ‘লিখছি তো আটচল্লিশ বছর থেকে একটি কবিতা…’

 

সুনীলের কাছে

ঘুমিয়েছো সুনীল?
আমার মাথা ঝিমঝিম করছে
ভিখেরী মানসিক ভারসাম্যহীন বা নেড়ি কুত্তোগুলোর
খয়ে যাওয়া গায়ের রঙ, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি সব এক হয়ে গেছে
রাতের অন্ধকারে বৈচিত্র্যহীন এইসব জীব।

সুনীল শুনছ?
পৃথিবীর পথে ওরা একটা প্রতিবাদের ধর্নায় বসেছে।

সুনীল
কতদিন আগে মানুষ সভ্য হয়েছিল?
কত শতাব্দী আগে ?
হরপ্পা মায়া যুগে কি ?
না তারও আগে নিয়ানডারথাল যুগে?
না যেদিন ওরা আলটিমিটার বা ভীমবেটকায় নিজের পরিচয় জানাতে পেরেছিল?
নাকি একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ এখনো সভ্য হয়নি?

সুনীল ঘুমোলে নাকি?
প্রাচীন চিনা-পদ্ধতির মত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি বুদ্ধকে নালিশ করেছিল
বুদ্ধ পারল কি?
বেচারা ক্রশবিদ্ধ যিশু অপুষ্ট শিশুর মতো তাকিয়ে আছে।

সুনীল ঘুমলে?
বললে না’তো ‘মানুষের চোখ খুনি, মানুষ ছুরির মতো ধারালো ?’

 

গলায় ক্যান্সার ধরা পড়েছে, তবু…

কোনো সমুদ্র এসে আমাকে আলালিত্য করবে না
কোনো দ্বীপের অচেনা নারী পথ দেখিয়ে স্বর্গের সিড়ির পাশে এসে বলবে’না
( সরল লজ্জিত ভাবে ) ‘যাও’।

তবুও সরস্বতীর বীণাটি একদিন ধার নেব
রবীন্দ্র সংগীত কাজী সংগীত গাওয়ার ইচ্ছে আছে।

বেতুস ভাবে নদীটি পাক খেয়েছে এখানে
আমাকে কেউ চেনে না
আমি কাউকে চিনি না
আরব্য রজনীর শেষ রাতে পা ফেলেছিলাম।

কতদিন থেকে বৃষ্টি নেই
কতদিন থেকে ভালোবাসা জন্ম দেয় না শিশু
মাটির রক্তে খাপছাড়া স্বভাবের বিষ।

গলায় ক্যান্সার ধরা পড়েছে
তবু বক ফুলের ডালে শালিকের ঝগরা হয়
রমেন কাকা ঘাড়ে লাঙল নেয়
বাজারে চায়ের দোকানে ভীড় পরে।

গলায় ক্যান্সার ধরা পড়েছে
তবুও সরস্বতীর বীণাটি একদিন ধার নেব
রবীন্দ্র সংগীত কাজী সংগীত গাওয়ার ইচ্ছে আছে।

 

শিল্পী, পোড়ামাটি এবং তোমার শহর

কাল রাতের একটা অসমাপ্ত আর্ট পড়ে আছে
শিল্পীর মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে যায়–

“তোমার যে পূর্বপুরুষ মিছিলে হেঁটেছে
এবং ছবিটির একটি গাছে বসে থাকা পাখিটি হঠাৎ উড়ে যায়–
তার বংশধরেরা কিছু লুপ্ত, কিছু লুপ্তপ্রায়
শহরের কাছাকাছি অনেকটা পোড়ামাটি এবং তোমাদের সব প্রাগৈতেহাসিক চিহ্ন…”

এই দৃশ্যে বনলতা সেনের পোড়া চুলের গন্ধ তোমার নাকে যায়?

শিল্পী আর কিছু মানুষ আছে, আর দু-একটা পাখি
এবং নদীটি নাব্যতা হারিয়ে শাড়ি-ব্লাউজহীন আশি বছরের বুড়ি
নদীটি শিল্পীকে তার শেষ প্রবাহটুকু এঁকে নিতে অনুরোধ করে
নদীকে শেষ চুম্বন দেবে শিল্পী ?

শিল্পীর ঘুম ভাঙে–

পাখিটি কোথায় উড়ে যাবে ?
যে বিপ্লবে খুন এবং রক্ত উৎসব পালিত– থাকবে ছবিতে ?
নদীটি মিছিলের পাশে শুয়ে ?

হঠাৎ তীব্র উন্মাদনা তুলিতে আসে– সুক্ষ্ম, একেবারেই সুক্ষ্ম রেখায়
শিল্পীর মৃত প্রেম, মৃত মানুষ তীব্র হাসে
স্থাপত্য ধ্বসে পড়ার দৃশ্যে– হঠাৎ চুড়ান্ত নিস্তেজ হয়
শিল্পী ঘুমায় ?

জারজ ইস্তেহার

কোথাও ফাঁকা মাঠ আছে? আমি ধান ফলাব।
কোথাও এক মাঠ জমি দেবে? পাখির নগরী তৈরি করব।
কোথায় সীমান্তে পাঁচিল নেই ?
কোন নদী যুবতি আজ, ন্যুব্জ হয়নি তো তার স্তনের স্রোত ?

রক্তের মধ্যে অনুরনন যোনি পথে কোন সমুদ্র নীল ?
কোন আকাশ নীল ?
ভালোবাসা টিকে আছে কোন অর্বাচীন দেশে ?
তাকে চাই আমার স্নায়ুগুলো উত্তেজিত।

বুলেটের ক্ষতটা এখনো শুকিয়ে যায়নি
এখানকার নদী গুলো শুকিয়ে গেছে
স্থাপত্যগুলো বারুদের আঘাতে চুরমার
সারি সারি মৃত্যু।

দু-হাত তুলে দাঁড়িয়েছি একটা ভাঙা কংক্রিটের উপড়
এর নীচে আমার পূর্ব-পুরুষ চাপা পড়ে আছে
এখানকার সব মাঠ দখল হয়ে গেছে।

কোথাও ফাঁকা মাঠ আছে আমি ধান ফলাব ?

 

সভ্যতার মুখপত্র

আর একটাও গ্রাম নেই
গোটা পৃথিবীটা একটা শহর।

একুশ শতক : কি ভাবছ দাঁড়িয়ে ?
দিন শেষের লাল বন্ধ্যা নারী নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে
তাকে ভালোবাসবে?
নাকি শেষ সহবাসের আছিলায়… তারপর ধসে পড়বে স্থাপত্য ?
অবনত মুখে নাকি আরো একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষা
চামড়া পোড়া রোদে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় চেরনোবিল হিংসার ?

একটা মিছিল কিন্তু বেরিয়েছে
সবুজ যোনি হারানো, নীল স্তন হারানো নারীটির।

 

নীচুতলা থেকে বলছি

হে মাননীয় নেতৃত্ব, নেমে এসো আমাদের রাজসভায়

ডাম্পিং গ্রাউণ্ডে দাঁড়াও কিছুক্ষণ
দেখো আমরা কিভাবে রত্ন খুঁজি

মন্দিরের ভেতরে নয়
বাইরে সিড়ির নীচে দেখো অদ্ভুত জীব

চলো বন্ধ কারখানার বস্তিতে
শপথ বাক্য পাঠ করো তারপর

‘ভাষণ’ তুলে দাও
মৌলিক অধিকারে আমাদেরও বক্তব্য আছে

হে মাননীয় নেতৃত্ব, তোমরা ভেবোনা জিতে গেছো অভিনয়ে !

মানুষের পৃথিবীতে আছি
অরুন্ধতী আমার প্রেমিকা

বিকেলের আকাশে মেঘেদের শাড়ি বদলানো দেখি
রঙিন মেয়েরা সূর্যের সাথে বিনিময় করে প্রেম।

অরুন্ধতীর এই শহর
অরুন্ধতী রবীন্দ্র সঙ্গীতের তাল লয় শেখে।

যে পাখিগুলো পৃথিবী শাসন করতে চেয়ে অধিবেশনের ডাক দেয়নি কোনোদিন
ওদের উৎসবে অরুন্ধতী গান গায়।

মানুষের পৃথিবীতে আছি
মিছিল মানুষ, অথবা লালসার মানুষ।

 

ভালোবেসেছি তোমার কুঠির শিল্পবাড়ি

নস্টালজিক আমি হই, ওটা আমাকে হতে হয়
অনেক নিঃসঙ্গ রাতে বা দুপুরে যখন ডায়রিটা খুলি
তারপর বহুদূরের তোমার বাড়ির সীমানার সাথে একটা বোঝাপড়া আসে
তারপর লুনি নদী হই, ওটা হয়ে যেতে হয়

এখন শুধু স্থাপত্যগুলো দাঁড়িয়ে
কাটা-ছেড়া চিহ্নে
কবিতার শহরে কেবল তোমাকে ছুঁই

অনেকদূর এগিয়ে গেছো অভিমুখে
আমার একটা কাধে ঝোলা ব্যাগ, আছি মিছিলে
একটা নষ্ট পৃথিবীর যতটুকু চাহিদা : ফুটপাতে মেলেনি এখনো
অনেকদূর এগিয়ে গেছো

ভালোবেসেছি তোমার কুটির শিল্পবাড়ি
সেইটুকু পাললিক শিলাস্তরে আজো আসে ঘুম… পর্যাপ্ত ঘুম ?

 

আমাদের কন্যাভ্রূণ গুলো

অ্যাবরশন করিও না
আমাদের কন্যাভ্রুণ গুলোকে বাঁচতে দাও
ওরা তোমাকে কোমলভাবে জড়িয়ে ধরতে চায়

এক দীর্ঘ বিশ্বাস সৃষ্টিতে
আদর করে ওদের চুমু খাবে
ঘুম পাড়ানির গানে তুমিও ঘুমিয়ে পড়বে ওদের পাশে।

এই জখম শহরের বিপরীতে
অনেকদিনের অবহেলিত গ্রাম। কৃষিকাজে।
আমাদেরও একটা ছোটো-খাটো সংসার হবে। সহজ।

জর্জিত বিপ্লব

কলকাতার মিছিলের মতো তুমি হাঁটো আমার হৃদয়ে
আমার শরীরে লেগে থাকুক তোমার ঘামের গন্ধ।

এখানে যত বিপ্লব ঘটে গেছে এতদিন
তাদের সব মৃত আত্মা প্রতিটি মিছিলভুক্ত মানুষের কাছে।

নাব্যতা কমে যাওয়া নদীটির শাড়ি-ব্লাউজ খসে পড়েছে
শুকনো স্তনে আশি বছরের বুড়ি মনে হয়।

অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়ানো নারীটি চোখ বুঝে কাঁদছে
হঠাৎ চা বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়ায়… এবার কালো গলিগুলো তাকে চিনে নেবে।

রাত বারোটা পেরোনোর আর তিন মিনিট
পৃথিবীর সীমান্তগুলো অস্থির, আর মানুষের কাল্পনিক ঘুম

বিপ্লব, কলকাতার মিছিলের মতো তুমি হাঁটো আমার হৃদয়ে
আমার শরীরে লেগে থাকুক তোমার ঘামের গন্ধ…

সূর্যাস্তের ভাষা

পঁচিশ বছর কেটে গেল
তেতুলীগুড়ি গ্রাম থেকে পৌঁছে গেছি শহরের গলিতে
জমে গেছে পাওয়া না পাওয়ার অনেক হিসেব।

ডায়ারির পাতায় : ‘নিখিলেশ তুই এসে দেখে যা আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি…’
এর উত্তর শুধু খুঁজেছি?
হ্যাঁ নিখিলেশ, তুই আজো এলিনা…

পঁয়তাল্লিশ বছরে আমার মা ভালো আছে ?
সাতান্ন বছরে বাবা এখনো শ্রমিক : বাবার কী অবসর নেই ?
এসব প্রশ্নের উত্তর রক্তে ঘুরপাক খায়।

পঁচিশ বছর কেটে গেল
এখন তীব্র রাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি?

সূর্যাস্তের ভাষায় এরপর কোন প্রচ্ছদ আঁকা হবে শিল্পী ?

 

অন্ধকার বারান্দা

উত্তরবঙ্গের চা বাগান গুলোর মধ্যে আপনিও একদিন আসুন না
দেখে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠিক চলে যাবেন
ভাববেন না, আপনাকে আটকাব।

আপনি আসুন
কয়েকটা দিনের ঘুম একটু বাড়িয়ে দিন
আর ও-কয়েক দিনের মধ্যে অপুষ্ট কতগুলো শিশু মরুক বা মেয়েগুলো যৌনপল্লীতে চলে যাক।

আপনি আসুন
সংবর্ধনা জানাতে আমরা কঙ্কাল শরীর গুলো নিয়ে হাজির হব
ফটোগ্রাফার নিয়ে আসবেন : আপনার এবং চা বাগানের ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করতে হবে তো।

আপনি এলেই ভোটগুলো আমরা ভিতরের পকেটে ঢেলে দেব
ঠিক আগের বার বা তারও আগে যেমন হয়েছিল।

 

কোন এক সভ্যতার দাগ

তারপর নদীর গভীরতা কমে আসে, কমে আসে ঢেউ
তারপর আগুনের ছাইয়ে জেগে থাকে কাল্পনিক উৎসব
এবং নদীর বুকে খনন করা গবেষক কেউ।

প্রিয় উপন্যাস :
গ্রাম তেতুলিগুড়ি। একটা ছোটো নদী। একটা বড় বট গাছ। হাজার খানেক পাখি।
দোলা ডাবরি। মানুষ।
ডারি ঘর। দোতরা।

মায়ের দুঃখিত রাত।
বাবার সামগ্রিক চিন্তা।

এরপর রক্তে ঝিলিক দেবে কোনো মিছিল ?
পৃথিবীর ভেতরে আগুন। উপরে ?
শুয়ে থাকা নদীর বুকে, খোড়ো গবেষক।

প্রতিটি স্তরে
রোদ। বৃষ্টি। অন্ধকার।
সুর। শব্দ। মানুষের মরে যাওয়া স্বপ্ন। আর জীবাশ্ম চোখের জল।

কোনো এক সভ্যতার দাগ।

 

তুমি মেধাবী ছিলে আমাদের পাঁড়ায়

তুমি মেধাবী ছিলে আমাদের পাঁড়ায়
রেখেছিলে লম্বা বেনী
তুমি সায়েন্স নিয়ে চলে গেলে শহরে
আমি সেই ছোটো নদী
তেতুলীগুড়ি গ্রাম, হ্যারিকেনের আলোতে
নিচ্ছি সিন্ধু সভ্যতা-মেসোপটেমিয়ার পাঠ
তোমার ছাঁদের আকাশে অঙ্ক
আমার ছবি-কবিতা-উপন্যাসের রাত।

তুমি রবি ঠাকুরের গান
শরতের দেয়াল পত্রিকা
তুমি খবরে এলে
কিংবদন্তী গবেষিকা।

মিছিলের ভীড়ে
ভীড়ে গেছি আজ আমি
কাজ, একটা কাজ
জরুরি।

সকালে এক কাপ লাল চা আর ঠোট
পঁচিশ বছরের যুবক
আমিও এখন শহরে
দেওয়ালে দেওয়ালে স্লোগান লিখি।

অনেক গলির রহস্য
অনেক বিবিক্ত দিন
অনেক মানুষে মানুষে খুন
দেখেছি।

ভুলে গেছি অনেক দিন
সহপাঠি, স্কুলে
বিদেশ থেকে হঠাৎ খবরে
প্রকাশিত হলে।

তুমি কি অবিষ্কার করেছো মিছিলের মানে ?
কেন এতো মানুষ খুন করে ওরা ?

 

উত্তরা নারী

উত্তরা, তুমি কী নারী নও ?
কতটুকু ভালবাসি জানো– একরাস ভাঙাচোরা যৌবনের ভেতর !

কিংবদন্তি তুমি
আমি-তো শিল্পি নই : এঁকে নিতে পাব তোমায় ?
দু-কথা লিখে অনাথ শিশুর মতো জড়িয়ে ধরতে পারব তোমার কোল ?
অথবা এক নিভৃত লজ্জাবোধ নিয়ে খেতে পারব চুমু ?

আমার কোনো কলম নেই
তবুও সংসার পেতে বসেছি তোমার সহবাসে।

ধ্বংসপ্রাপ্ত নদীর শুকনো স্তনে আমার কান্না লুকিয়ে আছে ;
তোমার অন্তবাসে যে নদী
তিলতিল করে এগোনো মৃত্যুদিনে
শতাদ্বীর লাঞ্ছিত নারীটির মতো তুমি কখন এসে দাঁড়িয়েছ আমার ধ্বংসাবশেষে !

দুরত্ব বেড়ে যায়

হিমাঙ্কের অনেক নীচে পারদ নেমে গেছে
তোর্সার পাড়ে ছোট শহর
শীতকালীন অধিবেশনে জমে আড্ডা
হঠাৎ প্রেমে পড়ি তোমার।

ইস্তেহারে থাকে অনেক প্রতিশ্রুতি
শিলান্যাসে ওঠে হাততালি জনতার
স্লোগানে রাস্তার দখল নেয় মিছিল
হঠাৎ প্রেমে দেখি ছেড়াতার।

বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠা সাংসদে
আমার প্রেম প্রস্তাব পেশ চাপা পড়ে
মুলতবি হয়ে যায় সভা
হঠাৎ আবিষ্কার করি রাস্তায় হাঁটছি একা।

আঁকা হলো না রামধনু ছবি
বোঝা হলো না এতো মিছিলের মানে
প্রতিশ্রুত এতো ইস্তেহারে
হঠাৎ দুরত্ব বেড়ে যায় তারপরে ?

 

ভানুমতির নস্টালজিয়া ভারতবর্ষ

কাল থেকে ভাবছি
ভানুমতির ভারতবর্ষের যেদিন মৃত্যু হল, আমি প্রতিবাদ করতে পারলাম না
দোবরো পান্না : যেদিন মুকুটহীন সম্রাটের… আমি রুগ্ন শিশুর মতো তাকিয়ে থেকেছি।

এই ভূমিকাটি কাল থেকে আমাকে বারবার তারা করছে।

অফিসে এই দু-দিনে কালো কাঁচের বাইরে মানুষ কত পা এগোলো?

মাথাটা ঝিমঝিম করছে
বুকে কীসের যেন একটা প্রচণ্ড ব্যথা
কাল থেকে টের পাচ্ছি একটু জ্বর জ্বর ভাব

সন্ধ্যায় জ্বরটা বাড়ল
শেষ রাতে একটু ঘুম ধরেছে কেবল
অমনি ভানুমতি দু-হাত তুলে ডাকছে, সেই চেনা ভানুমতি
ইতস্তত ওর হাতটা ধরতে যাচ্ছি
অমনি স্ত্রী বলে ‘আঃ করছো টা এতো জ্বরে ?’

আসলে রুমের দরজাটা খুলছিলাম…

ভানুমতি মায়া সভ্যতার মানুষ গুলোর মতো হারালো
ভানুমতির নস্টালজিয়া ভারতবর্ষের মৃত্যু হল, আমি প্রতিবাদ করতে পারলাম না।

 

নৈব নৈব চ

আমার একনায়কতান্ত্রিক চোখে
তখন গান্ধী নামে এক সভ্যতার মৃত্যু হয়।
মার্টিন লুথার কিং চাপা পরে যান বন্দুকের ভিড়ে
সুপ্ত আগ্নেয়গিরির গর্ভ থেকে একের পর এক জীবানুর জন্ম হয়।

আমার হৃদয়ে তখন ‘খুন’
মার্কসের লুটিয়ে পড়া দেহ
বুদ্ধের বামিয়ান মূর্তিটি গুড়িয়ে দেওয়া হয়।

আমার একনায়কতান্ত্রিক চোখে বৃষ্টিহীন দেশ
বারুদের উপর আটাকোমা মৃতের সাগর গড়ে ওঠে।

অথচ কখনো এমন কথা ছিল না।

 

রোদ্দুর ও বকুল

খোঁপার চুল খুলে এসো
বেঁধে দেই বেনী
রোদ্দুর।
না বকুল, সেঁজুতি ফুটেছে অনেক
যাই তুলে আনি।

শিশির কুয়াশা তোমাকে জড়িয়েছে
কাঁচা সবুজ পাতা আরো সবুজ
একটু দাঁড়াও না!
না বকুল বেলা হবে। তাছাড়া মন্দিরে…

ওঃ প্রজাপতি লজ্জাপতি রোদ্দুর।
বকুল এমন বলে!

ছোট ছিলে এখন বড়ো
দৃষ্টি টুকু আকাশের চাঁদ বদলে তো যায়নি।
যা!

ঘাসের জানালায় কত খুঁজেছি
উনিশটি বছর
অনেক নদীর জল সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে
একটু হাঁসো’না
এই!

দেখি খোপা তাঁর খুলে গেছে
হাওয়া চোর তখনও ওড়াচ্ছিল চুল
দাঁড়িয়ে আছে বোবা মেয়ে
বলি ‘রোদ্দুর সেঁজুতি আনার বেলা হল না ?’

 

সেই পলক পড়ানো মেয়েটি

সেই পলক পড়ানো মেয়েটি কাদার মতো নরম খনিজ হয়ে এসেছে
নিরক্ষীয়তার নৃতত্ত্ব হাসি হাসতে হাসতে
সে একা
একার মতো
রাতচোরা পাখিটির সুর তুলে
চলছে, চলে যাচ্ছে

পলিমাটি শাড়ি
চৈত্রের সবুজ চুল
হেঁটে।

নিঃশব্দ হই
চোখ বন্ধ করি
দেখি
কাছাকাছি, আরও কাছাকাছি ঘনিষ্ট কান শোনে, পায়ের উৎসবে
নদী পাহাড় সমভূমি থেকে
মানুষের বিরক্ত মিছিল বিপরীতে
হেঁটে, একা

সমুদ্রের চওড়া বুকের গভীরতা
সুদীর্ঘ এক প্রস্তাবে
মুখোমুখী সে এবং অন্ধকারের যৌনতা।

 

কবিতা লিখেই কি তোমায় পাব?

এই-যে কবিতা লিখছি–
কবিতা লিখেই কি তোমায় পাব ?

বিনয় মজুমদার পেয়েছিলেন গায়িত্রীকে ?
অথবা জীবনানন্দ বনলতাকে ?
কিংবা নীরাকে সুনীল ?
হাংরিরা পেলেন তাদের বাস্তবের নারীকে ?
ইদানিং জয়, সুবোধ… তাঁরা পেয়ে গেছেন ?

বইমেলায়, কবিতা পাঠে যে সুর ওঠে
তাতে, তোমাকে যে আবিষ্কার করি
পাব? এভাবেই কি তোমায় পাব ?

যদি যাবেইনা পাওয়া
তবে লিওনার্দো কেন আঁকলেন মোনালিসা ?
এতো গুহাচিত্র কেনইবা ফুটিয়ে তুললেন শিল্পী ?

তাহলে মানুষের কেন এতো প্রয়াস ?
কোটি কোটি কীটের কেন এতো অভিযোজন ?

সুতরাং এই-যে কবিতা লিখছি–
কবিতা লিখেই কি তোমায় পাব ?

 

বৃষ্টি– ১

বৃষ্টি যদি পুরুষ হয়।

বৃষ্টির মতো দুঃখ কারো নেই। অথবা সুখ।
ওর চোখের জলে জাদু আছে।

আমি দেখেছি প্রচণ্ড শক্তিশালি বৃষ্টি পৃথিবীকে গর্ভবতী করে তোলে।

অথবা সে যদি নারী হয়।

বৃষ্টির মতো সহজ কেউ নেই। অথবা কঠিন।
ওর চুলের ঢেউয়ে রূপকথা আছে।

আমি দেখেছি কালো শাড়িতে বৃষ্টির পুষ্ট শরীর প্রেমিকের জন্য অপেক্ষারত কেঁদে কেঁদে।

বৃষ্টি যদি কেবল মানুষ হয়।

বৃষ্টির মতো পরিশ্রমি কেউ নেই। অথবা আরামপ্রিয়।
ওর মাথার ভেতরে সংগ্রাম আছে।

আমি দেখেছি অন্ধকারের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বৃষ্টির তীব্র বিপ্লবী বেদনা।

বৃষ্টি– ২

বৃষ্টি, তুই আগের মতো আছিস?
আমি এখন মহানাগরিক : কোচবিহার শহরে থাকি।

চেরাপুঞ্জীতে তুই কি আগের মতো যাস?
আমাদের এখানে সব গাছ কেটে ফেলেছে জানিস!

তোর সঙ্গে যখন ভিজতাম
আমাদের তেতুলিগুড়ি গ্রামে– তোর মনে আছে?

তুই তো দক্ষিন-পশ্চিম থেকে আসিস
ওই দিকের ভারতবর্ষে খুন হয়? আর মিছিল বেকারদের ?

একজন বলেছেন–
‘বর্ষা উপন্যাসিকের বিদেশ, কবির স্বদেশ’– সত্যি কি ?

কেউ ‘মেঘদূত’, কেউ ‘ভরা ভাদর’ লিখে কিংবদন্তি করল তোকে
এখন তোর এতো অ্যাসিড রাগ কেন ?

তুই তো এদিকে আর আগের মতো আসিস না
রাস্তাগুলোতে মিছিলের ভীড়, কি আসবি– খুব জ্যাম।

 

সুজাতাকে– ১

সুজাতা আজকে এসো
রক্তে পিচ্ছিল হয়ে গেছে গলি, তবু–

আমার পচন ধরা শরীরে ক্যান্সার ঘরবাড়ি বানিয়েছে
সে এখন আর যাযাবর নয়
তোমার আগমনে সে বিজয় উল্লাস প্রকাশ করবে

আমাকে না ছুঁয়েই চলে যেও
তোমার মাক্স পড়া মুখে, নার্সের হাত মোজায়…
তোমার যৌবন উদ্দীপ্ত জীবন…

খুব তারাতাড়ি এখান থেকে চলে যাবে
খুন হয়ে যেতে পার হঠাৎ
এখানে সবাই খুনি, পাগল
পাগলরা কোনোদিনই ভালো মানুষকে দেখতে পায় না।

আমার শরীরে আর একফোটা রক্ত নেই
ভাইরাস, ভাইরাসের মিছিলের রগ।

সুজাতা আজকে এসো
না হয় চোখ থেকে খসে পড়া দু’বিন্দু জল উপহার দেব,
–দেবে!

 

সুজাতাকে– ২

“কখনো কোচবিহারে এলে আমার বাড়ি এসো
ঠিকানা– বিবেকানন্দ স্ট্রীট, ভারতী সংঘ, কবিতা বাড়ি।”

চিরকুটটি কি এখনো তোমার কাছে আছে? না হারিয়ে গেছে?
আর তোমার পুরোনো ঠিকানাটা?

সুজাতা,
হেরিটেজ শহরের দাবিদার আমরা
তোর্সার পাড়ে সন্ধ্যায় :
চার বছর আগে গঙ্গার ঘাটে যেমন বসতাম
তোমার পরবর্তীতে তার সঙ্গেই আমার বিশেষ সম্পর্ক হয়েছে
তারপর তোর্সাকেও একদিন জিঞ্জেস করেছি আমাদের সম্পর্কটা…?
উত্তরে সে জানিয়েছে– ‘বলাটা জরুরি কি?’
তোর্সাও কি বুঝতে পেরেছিল? বেকারত্ব ভয়াবহ অস্তিত্বহীন ভবিষ্যৎ!

ও হ্যাঁ গঙ্গায় এখন কতোটা জল সুজাতা ?
ঘাটটির লাল রঙ পালটে কি অন্য রঙ করা হয়েছে ?
কলকাতায় কি আগের মতো মিছিল হয় ?
বইমেলায় অমন ভীড় ?

সুজাতা,
আমার আগের ঠিকানাটা পালটে গেছে
বর্তমানে বিয়াল্লিশ কিলোমিটার পশ্চিমে তেতুলিগুড়ি গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি
এখানেও একটা ছোটো নদী আছে
সে অবশ্য আমাকে গান শোনায়, তারও একটা তীব্র মরে যাওয়া দুঃখ আছে

সুজাতা, কখনো অবসর হলে ফিরে এসো এই গ্রামপথে।

 

সুজাতাকে– ৩

যে জায়গাটায় তোর আর আমার মিল
সেখান থেকে :

কাল রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত একটা চিঠি লিখেছি ফিদেল কাস্ত্রোকে
একটা প্রবন্ধ ছেপেছিস তুই শুক্রবারের পাতায় ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেননি কাস্ত্রো’

আচ্ছা সুজাতা ভারতের না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর গণতন্ত্র তাদের কি খেতে দিচ্ছে ?
নারীবাদ নারীবাদ বলে এত চিৎকার : নির্ভয়া কি গণতন্ত্র দেশের মেয়ে ছিল না ?

তুই যখন রেল লাইনে বোতল কুড়োনোদের উপন্যাস লিখিস : আমার ভালো লাগে।
ভালোলাগে, চা বাগানে তোঁর সাহায্য

 

ছবি – গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By কিশোর বর্মণ

কোচবিহার

Leave a Reply