নিসর্গ নির্যাস মাহাতোর গল্প

শিরোমণির সমাধি

 

মুহূর্তের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। ও হাসছে। পাগলের মত হাসছে। গাছে হেলান দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে মাধবীলতা। তারও চোখে জল। মাটি চাপা দিচ্ছে মুহূর্ত। মুঠো মুঠো মাটি। কেউ জানবে না। আর কেউ জানবে না।

হাত বাড়াল যুবক। চোখে জল নিয়ে ধীরে ধীরে কয়েকটা কৃষ্ণচূড়ার চারা এগিয়ে দিল যুবতী। মুহূর্তের চোখের জল মিশে গিয়েছে ঘামে। ঠোঁটের কোণে কাষ্ঠ হাসি নিয়ে মাধবীলতার হাত থেকে কাদা মাখা হাতে চারাগুলি তুলে নিল সে।
মাটিচাপা দেওয়া জায়গাটাকে মাঝে রেখে তার চারধারে দশটা ছোট ছোট গর্ত করল। প্রথম গর্তে একটা কৃষ্ণচূড়া চারা পুঁততে গিয়ে থমকে গেল। চোখের ইশারায় মাধবীলতাকে পাশে এসে বসতে ইঙ্গিত করল। তারপর চারাটা তার হাতে তুলে দিয়ে বলল, আমি নয়, সবকটা আগামীকে জীবন দিও তুমি। কথা না বাড়িয়ে খোলা চুলকে খোঁপা করে বেঁধে নিল আঠাশ বছরের যুবতী। একটা একটা করে চারা পুঁতছে সে আর মুহূর্ত আঙুলের চাপে শক্ত করে দিচ্ছে সদ্য পোঁতা চারার গোড়ার মাটি। তারপর মাটি মাখা হাতেই নিজের ব্যাগ খুলে ফেলল মাধবীলতা। বের করল জলের বোতল। এই প্রথম সে কোনও কাদা মাটিকে প্রশ্রয় দিল। না হলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতেই পছন্দ করে। অতি খুঁতখুঁতে যুবতীও আজ ভাঙল নিয়মের বেড়াজাল। চারা গাছগুলোতে অল্প অল্প জল দিচ্ছে দু’জনে। এই আগাছা ঘেরা জায়গায় কেউ লক্ষ্য করছে না তাদের। সকলেই ভিড় জমিয়েছে অদূরে নয়া পর্যটন কেন্দ্রে। এখন এই জায়গাটিকে অন্যভাবে চিনেছে সবাই। স্টেট প্রটেক্টেড মনুমেন্টের তালিকায় সদ্য জুড়েছে কর্ণগড়ের রানি শিরোমণি গড়। শুধু দূরে আছে মুহূর্ত আর মাধবী। যাদের দু’চোখ জুড়ে শুধুই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে খুঁড়ে চলার তাগিদ।

কুশায়ার মতো ঘন সন্ধে ঘিরে আসছে। দুজনে বসে আছে পারাং নদীর ধারে। মুহূর্ত বিড় বিড় করে বলে চলেছে- ‘কর্ণগড় মন্দির থেকে পারাং নদী ধরে পশ্চিম দিকে গেলে কিছু দূরেই আছে একটা জঙ্গলাকীর্ণ স্থান। আর সেখানে রয়েছে বিদ্রোহিণী রানি শিরোমণির নীরব সমাধি’। বাউণ্ডুলে ছেলেকে কথাগুলি বলেছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অন্নপূর্ণা চট্টোপাধ্যায়। মুহূর্তের লক্ষ্য তখন ছিল শুধুমাত্র জরাজীর্ণ ওই ধ্বংসস্তূপগুলোর হেরিটেজ মর্যাদা আদায় করা। এক আকুল চেষ্টা। পাগলের মতো ছুটে বেড়িয়েছিল। আবেদন ছিল, খননকার্য হোক। কেউ পাত্তা দেয়নি। দিনের পর দিন উপহাস ঘিরে ধরে ছিল মুহূর্তকে। মুখ বুজে নিজের জেদ ধরে রেখেছিল বাউন্ডুলে ছেলেটা। আজ পর্যন্ত কোনও কাজেই স্থির থাকতে পারেনি এই ছেলে। শুধু ইতিহাসের মায়ায় এমন জড়িয়ে গেল যে আজও বের হতে পারল না ওই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে।
এত বছর ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে বিভিন্ন জায়গা এলোপাথাড়ি ভাবে খুঁড়তে খুঁড়তে মুহূর্ত পেয়ে গেল সেই সমাধি। সেনোটাফ। আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠেছিল চোখ। এই কাজে মাধবীলতা ছাড়া তার সবার ওপরেই অভিমান। মুহূর্ত জানে, এর গুরুত্ব দেবে না কেউ। আজ সেই বাউন্ডুলে ক্লান্ত ছেলেটা ঠিক করে ফেলছে, মাধবী ছাড়া আর কেউ জানবে না ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনীর শেষ ঠিকানা।
চারিদিকে অন্ধকার জমাট বেঁধেছে। বেরিয়ে এল ওরা দু’জনে। যুবতীর ইচ্ছে চারাগুলোর চার পাশে বেড়ার পাহারা দেওয়া। সে কাজ শুরু হবে কালই। তাতে ওদের অনাগত আগামীরা ভরে যাবে লাল কৃষ্ণচূড়ায়। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আছে ওই ফুলে। শিরোমণির সমাধির ওপর ঝরে পড়বে রক্তবর্ণ হৃদয়। আর কেউ জানবে না এই নীরবতার কথা।

শুধু এসে বসবে মাধবীলতা আর মুহূর্ত।

 

ছবি – লেখক

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By নিসর্গ নির্যাস মাহাতো

বাড়ি মেদিনীপুর, শখ: লেখালেখি। প্রকাশিত কবিতার বই: 'ভেঙে যায় চৌকাঠ দেশ ও বাড়ি'

Leave a Reply