একটি ছাদের গল্প
অলকেশ শখের লেখক। বেশকিছু পত্রপত্রিকায় লেখা টেখা বেরোলেও, মাঝেমধ্যে লেখালিখির খেই পায় না। কী লিখবে খুঁজে না পাওয়াটা তাকে ভারি যন্ত্রনা দেয়। শুনেছে বড় বড় লেখকদের নাকি অনেকরকম অদ্ভুত অভ্যেস থাকে। অলকেশ ভাবে, ওই অভ্যেসটভ্যেসগুলোই লেখাগুলোকে মগজের ভেতর থেকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসে। তাই ইদানীং মাঝরাত্তিরে ছাদে উঠে অলকেশ ভয়ঙ্কর পায়চারি শুরু করেছে। গিন্নি প্রথমটা ভয় পেয়েছিলো, কিন্তু পরে বুঝে গেছে পাগলকে নিয়ে সংসার করতে গেলে মাঝেমধ্যে এসব উৎপাত সহ্য করতে হয়। তাই মাঝরাতে বিছানা ফাঁকা হয়ে গেলে ঘড়ি দেখে আবার শুয়ে পড়ে। গতকাল যেমন দেখেছিল রাত আড়াইটে।
সকালবেলা উপুর্যপরি তিন বার হাঁচির আওয়াজ শুনে অলকেশের মাথায় কুন্তলা একটা টুপি পরিয়ে দিয়ে বলেছিল “ভূতের গল্প লেখো। রাত দুপুরে ছাদের ওপর আর কিসের দেখা পাবে?” শুনে অলকেশ তার বিরলকেশ মাথাটা পেছনে হেলিয়ে ঠা ঠা করে হেসে বলেছিল, বাড়িতেই তো একখানা শাকচুন্নি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই শুনে কুন্তলা ফিক করে হেসে বলেছিল “পাগলের কী বা দিন কী বা রাত? সকালবেলাও চোখে শাকচুন্নি দেখছে!”
অলকেশের এসব কথায় মন নেই। বউয়ের কথায় কান দিলে চলে না। একটা নতুন লেখা লিখতেই হবে, নইলে “বাঁশ ঝাড়” পত্রিকার সম্পাদক ছাড়বে না। নামটা এরকম অদ্ভুত কেন প্রশ্ন করাতে সম্পাদক বংশীচরণ সরখেল গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছিলেন, “চারিদিকে যেখানে মানুষ বাঁশ খাচ্ছে, সেখানে কী করে নামকরণটা শিহরিত শব্দমালা টাইপের কাব্যিক নাম রাখা যায়? চারিদিকে বাঁশ, অফিস বলুন, বাড়ি বলুন, পাড়া বলুন, সর্বত্রই মানুষ মানুষকে বাঁশ দিচ্ছে, তাই সমকালকে তুলে ধরতে পত্রিকার নাম “বাঁশ ঝাড়।” অলকেশ এরকম চমৎকার যুক্তিতে বেশকিছুক্ষণ বাকরহিত হয়ে বসেছিল। তারপর সম্পাদককে বলে এসেছিল, “বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই…” কবিতাটা মনে পড়ে গেল। বংশীচরণ সরখেল কবিতাটি আগে পড়েনি, জিজ্ঞেস করেছিল “অপূর্ব, কার লেখা?” অলকেশ বলেছিল “আমার শ্বশুরের।” শুনে বংশীচরণ বলেছিল “আহা আহা, আপনার শ্বশুরমশাইকে বলুন না পদ্যটি দিতে, ছেপে দেবো।” অলকেশ বলেছিল “চেপে যান, তিনি স্বর্গে।” এরপর তড়িঘড়ি অলকেশ বেরিয়ে পড়ে। বর্ষাকাল, বৃষ্টি এলে আর ১৩ নম্বর ইলিয়াস ওস্তাগর লেনে ঢোকা যাবে না। জলে থইথই।
কিন্তু লেখাটা কিছুতেই মাথায় আসছে না। আজ আবার পূর্ণিমা। চাঁদের সঙ্গে লেখকদের গভীর সম্পর্ক। অনেকটা জোয়ার ভাটার মতো। চাঁদ দেখলে লেখা আসে। চাঁদ নিয়ে কাব্যি কি কম করা হয়েছে? দেখা যাক!
মাঝরাতে একটা ছাতা নিয়ে ছাতে উঠে অলকেশ বিড়ি ধরালো। টিপটিপ বৃষ্টি, চাঁদের দেখা নেই। অলকেশ ভাবলো “নাহ, আজকের রাতটাও মাটি হলো।” মশা কামড়াচ্ছে, এমন সময় হঠাৎ দেখে “কোণে ওই বস্তা মতো কী রে?” সব্বোনাশ, তাহলে কি কুন্তলার কথাই সত্যি হলো? শাকচুন্নি? অলকেশ ওখানেই জমে গেল। প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে গেছে, বস্তাটা একটু যেন নড়ে উঠলো না? উফফ কী ভয়ঙ্কর! আরেস্সব্বোনাশ! বস্তাটা এদিকেই আসছে, অলকেশের চোখ দুটো কপালে উঠেছে, মুখ দিয়ে “কু কু” করে আওয়াজ বেরোচ্ছে। ভয় যখন ভয়াল, বস্তাটা সামনে এসে দাঁড়ালো, অলকেশ প্রায় অজ্ঞান, শাকচুন্নিটা বলে উঠলো “আর কু কু করে ডাকতে হবে না, এই যে কুন্তলা। শাকচুন্নি বলেছিলে না? নাও এবার দেখো। অলকেশের ধরে প্রাণ ফিরে এল। কাশতে গিয়ে, বিষম খেয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে সামলে নিয়ে বললো, “দিলে তো সব মাটি করে? চরিত্রটার মধ্যে প্রায় ঢুকে পড়েছিলাম, দেখছিলাম সত্যি সত্যি শাকচুন্নি এলে মানুষের কী অবস্থা হয়! এজন্যই বলে মেয়েরা কোনো কাজের গুরুত্ব বোঝে না। চলো, এত রাতে আর ছাদে থাকতে হবে না।” বলে কুন্তলার আগে আগে বীরদর্পে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। কুন্তলা স্মিত হাসিটি বজায় রেখে বললো, “ছাতাটা যে ফেলে যাচ্ছো, সে খেয়াল আছে বীরপুঙ্গব? আর দেশলাইটা যে ভিজবে?”
অলকেশ অনেকদিন পর সেদিন রাত্রিবেলা আরামের ঘুম ঘুমিয়েছিল। “বাঁশ ঝাড়” পত্রিকা থেকে অলকেশকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। যে গল্পটি লিখেছিল, তার নাম হলো “ছাদের ওপর ব্যাকুল বাঁশি।”