শাশ্বত বসুর গল্প

পুতুল বাড়ি

-নির্বাক ইতিহাসের সিলেবাসে অনেক অগোছালো প্রশ্নের বাস

মাঝে মাঝে মনে হয় কলকাতাটা একটা আস্ত জঙ্গল| বুড়ো বটের পাতার ফেটে চৌচির অবস্থা এমন একটা সময়ে, ফুটিফাটা জালের মধ্য দিয়ে সূর্য্যের প্রথম আলো একটা পথ হারানো নাবিককে, শহরটার বুক চিরে পথ দেখায়| উত্তরের গলিঘুঁজি পেরিয়ে আলগোছে রোদ মেখে, ভাঙা কার্নিশে গড়িয়ে পরে নীল কালি মাখা কাকটা| দিনের ঠিক সেই সময়টাতেই এ শহরের বুক বেয়ে, ভরা বর্ষার মতো ভেসে যেতে ইচ্ছে করে প্রেমের উদ্যাম প্লাবনে| শহরটারও মাঝে মাঝে বুঝি যাযাবর হতে ইচ্ছে হয়, মিছিল-বন্ধুতা-পাপ বোধ-যৌনতার বেড়াজাল টপকে| ইতিহাস জানার থেকেও তখন শহরটার মনকেমনের সাথী হয়ে ওঠাটা আমার কাছে বেশী জরুরি হয়ে পরে| শোভাবাজার ঘাট থেকে নিদাঘ বৈশাখের বিকেলে হাওয়ায় চড়ে ডাক আসে “হে রাম !”, নিমতলার লিট্টি চোকা আর “রাম তেরি গঙ্গা মইলি” র হাত ধরে| একটাই রেল লাইন, সেটা বেয়ে কখনও শিয়ালদহ থেকে বা কখনও শিয়ালদহ এর দিকে রেল চলে যায় ঝপা ঝাই শব্দে, বাড়িটার গায়ে দোল লাগিয়ে| ঠিক ট্রেনের হুইসেল শুনলেই অজ্ঞাতে লাইন পার হওয়া মানুষের চোখ চলে যায় বাড়িটার মাথায় তিনটে পুতুলের, উদার হরষে নাচন কোদনের দিকে| ওদের এই নাচ যেন কত চিল-শকুন সকাল-সন্ধ্যা, অবেলার ঝড় জল বৃষ্টি পেরিয়ে বাড়িটাকে নিয়ে ঢুকে যাবে আগামী অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমায়| লাইন টপকে ওপার থেকে আসতে হয় বাড়িটায়| দূরে গঙ্গা, একদিন হয়তো এই বাড়ির খুব কাছ ঘেঁষে বইতো| ১৭ শোভাবাজার স্ট্রিট, হাটখোলার এই বাড়িটাকে ব্রিটিশ কালে ব্যবহার করা হত ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার আতশী ফসল, সত্ত্বভোগী বানিয়াদের গঙ্গাবক্ষে বজরা গর্ভে, বহন করে নিয়ে আসা পণ্য মজুত করার জন্য| বাড়িটা হয়তো শুধু একটা গুদামঘর হয়েই থেকে যেত| কিন্তু বহুযুগ আগের এই বাড়িটা পিগমেন্টেড কলকাতার ইতিহাসে নিজের দোমড়ানো শিরদাঁড়া টা নিয়ে, আশ্রয় খুঁজেছিল বোধহয়| বুকের ভিতর পুষে রেখেছিল অনেক অজানা গোপন অসুখ| আর প্রতিটা দিন প্রতিটা রাত আরো কুঁকড়ে যেত, রাতের মেহফিলে গজল-ঠুমরীর সাথে ভেসে আসা বিধবা তরুণীর চিৎকারে| বাড়িটাকে দূর থেকে দেখলে মনে হবে, পৃথিবীর সকল গরিমার ধুলোকাদা মেখে প্রৌঢ়ার ঘুমন্ত স্তনের মত, নিজের বুকের শোভা বাড়িয়ে রেখেছে পুরোনো আমলের কাঠের ঝুল বারান্দাটাকে এগিয়ে দিয়ে| সদরের দরজাটা কায়াহীন বিষন্নতায় পাংশু মুখে হয়তো অপেক্ষা করছে কোনো এক কাকতালীয় আগন্তুকের| ভেতরে লম্বা কাঠের সিঁড়ি, বিমূঢ় নিশ্চল একটা অন্ধকারে ঢাকা| গায়ে কলোনিয়াল স্থাপত্যের নিদর্শন| সিঁড়ি বেয়ে যদি উপরে ওঠা যায়, প্রতিটি কাঠের পাটাতনে হয়তো বহু রমণীর না বলা কথা শুনতে পাওয়া যাবে| কান পাতলে ফিসফিসানির শব্দটা হিসহিসে শোনায়| বাড়িটার দোতলায় এক আশ্চর্য্য উঠান, সামনে পুরানো নাটমন্দিরের মত বিস্তীর্ণ খিলান| দুপাশে বাদামী প্রহর থেকে তাজা শোকের গন্ধ ছড়ানো, ক্রূর, ক্ষমাহীন একাধিপত্যের সাক্ষী হয়ে সার সার দরজা দাঁড়িয়ে আছে| দরজার মাথায় গথিক স্কাল্পচারের এঁটুলি হয়ে ঝুলছে মস্ত মানুষের মুখ| সে মুখে এক নরখাদক পাপবোধ| হয়তো ওরাই কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া প্রতিটা পাপের একমাত্র জীবন্ত সাক্ষী| ওরাই জানে কোন দেওয়ালে, কোন ভাস্কর্যের ভিতর পোঁতা আছে, কোন অসহায় তরুণীর দেহ| এ বাড়ির কোন অজানা কুঠুরীতে কোন রাতে ঠিক কতবার সম্ভোগের পর কোন পরিচারিকাকে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়েছে| সব দেখেছে ওই মুখগুলো| দরজাগুলোর গায়ে ছোট ছোট খোপে সুলতানি আর্চের ভেতর অনুষ্টুপী গঠনশৈলীর পুতুল খোদাই করা| এরকমই কোন এক ঘরের দরজা ঠেললে হয়তো আপনা থেকেই খুলে যাবে| দেওয়াল জুড়ে অদৃশ্য জাদুওয়ালার মায়ায় ঘুমোতে দেখা যাবে, একদল পুতুল কে| কোনো অনাম্নী নারী শিশুর খেলার পুতুল| তাদের ভেতর সব থেকে মিষ্টি যে পুতুলটা সেটাই হয়তো চোখ মেলে হাসিমুখে বলে উঠবে

“পুতুল মোরা সবাই পুতুল, পুতুল দেশের রাজ্যে|

এই বাড়িতে ঢুকলে পরে পুতুল তোমায় হতেই হবে,

পুতুল হয়ে হুকুম কষা এটাই তোমার কাজ যে|”

ছিটকে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসে উপরের দিকের খোলা অংশটা থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোটার দিকে তাকালে, ভাঙা ইট কাঠ বুলন্দ দরওয়াজা পেরিয়ে একফালি আকাশ দেখা যাবে অতীত কালের থেকে| পুতুল বাড়ির সব অসুখ সারিয়ে দেবার মত একটা হাওয়া গায়ে এসে লাগবে, যে হাওয়াটা আহিরীটোলা ঘাটের দিক থেকে উত্তর কলকাতার সব কটা গলিতে, নধর শরীরে ছড়িয়ে পরতে চেয়েছিল কোনো এক মহাজাগতিক কাব্যের পোয়াতি বিকেলে|

 

ছবি – লেখক

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By শাশ্বত বোস

জন্ম ১৯৮৯ সালের জানুয়ারী মাসে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুর শহরে । হুগলী জেলারই রিষড়া শহরে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ২০০৫ ও ২০০৭ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন । ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখালেখির সাথে যুক্ত। বিভিন্ন নামী পত্রিকা যেমন সন্দেশ, জোয়ার, কোরক, পথ ও পাঁচালি ইত্যাদি পরিবারের তিনি নিয়মিত সদস্য ছিলেন ।

Leave a Reply