প্রথম দেখা: এক ঝড়ো সন্ধ্যায়
সেদিন কলকাতায় প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। রাস্তার যানজট, ফুটপাতের হুটোপুটি—সবকিছু যেন শহরের চেনা রূপকেই আরও প্রকট করে তুলেছিল। হিমিকা একটি ছাতা হাতে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়েছিল একটি অচেনা শিশুকে রাস্তা পার করাতে। রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে রোহিত তার গাড়ি থেকে নেমে এই দৃশ্য দেখছিল।
“তোমার ছাতা তো ভেঙে গেছে, কেন এই ঝড়ে শিশুটিকে সাহায্য করতে যাচ্ছ?”—প্রথমেই রোহিত জিজ্ঞেস করেছিল।
হিমিকা হেসে বলল, “ছাতা ভাঙতে পারে, কিন্তু দায়িত্ব ভাঙে না। এই শিশুটি আমার দায়িত্ব।”
রোহিত সেদিন কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু তার মনে হয়েছিল, এই মেয়েটির হৃদয় খুবই গভীর। বৃষ্টিভেজা কলকাতার সেই সন্ধ্যায় তাদের আলাপ সেদিন শুরু হয়েছিল, কিন্তু তাদের গল্পের প্রথম পৃষ্ঠা যেন খুলে গিয়েছিল।
বন্ধুত্বের সূচনা
এরপরের কয়েকটি দিন রোহিত আর হিমিকার দেখা হয়েছিল বিভিন্ন সামাজিক ইভেন্টে। রোহিত ছিল একজন পেশাদার স্থপতি, আর তার অনেক প্রকল্প শহরের দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক ছিল। হিমিকা তার উদ্যোগের অংশীদার হয়ে উঠেছিল, কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল একই—একটি ভালোবাসাময় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করা।
তাদের কথাবার্তার মাধ্যমে দুজন একে অপরের ব্যক্তিত্বের গভীরতাকে আরও ভালোভাবে বুঝতে শিখল। রোহিত লক্ষ্য করল যে, হিমিকার দৃষ্টিভঙ্গি কেবল মানবিক নয়, বরং তার চিন্তাভাবনার গভীরতায় ছিল এক বিশেষ আবেদন। অন্যদিকে, হিমিকা রোহিতের সৃজনশীল মনোভাব আর বাস্তবমুখী চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হল।
তারা একে অপরের প্রতি গভীর আগ্রহ অনুভব করতে লাগল। কিন্তু এটি বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু হতে সময় লাগেনি।
প্রেমের উন্মেষ
একদিন রোহিত হিমিকাকে বলল, “আমাদের একটি বড় প্রকল্প শুরু করতে হবে। শহরের দক্ষিণের এক বস্তি এলাকার জন্য একটি সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প।”
হিমিকা খুশি হয়ে বলল, “আমি তোমার পাশে আছি। কিন্তু তুমি জানো, এই কাজ শুধু ইট-সিমেন্ট নয়, বরং মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনবে। আমাদের এই কাজের মাধ্যমে তাদের জীবনে আশার আলো জ্বালাতে হবে।”
সেই দিন থেকেই তারা একসঙ্গে দিনরাত কাজ শুরু করল। কাজের ফাঁকে রোহিত হিমিকার সৃজনশীলতায় মুগ্ধ হয়ে উঠল, আর হিমিকা রোহিতের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাকে সম্মান করতে শুরু করল।
এক সন্ধ্যায়, কাজ শেষে তারা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সবুজ ঘাসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। আকাশের লালচে আলো আর পাখিদের ডাকের মধ্যে হিমিকা বলল, “রোহিত, তুমি কি কখনো ভেবেছ, আমরা জীবনে কী খুঁজছি?”
রোহিত হাসল। “হ্যাঁ, আমি খুঁজছি এমন কিছু যা স্থায়ী হবে। যেমন, এই প্রকল্প। কিন্তু তুমি? তুমি কী খুঁজছ?”
হিমিকা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “আমি খুঁজছি এমন কিছু যা শুধু স্থায়ী নয়, বরং গভীর। যেমন ভালোবাসা। এমন ভালোবাসা, যা মানুষকে বদলে দেয়।”
রোহিত তখনই বুঝল, সে হিমিকার ভালোবাসায় ধীরে ধীরে বন্দি হয়ে পড়ছে।
প্রথম স্বীকারোক্তি
একদিন প্রকল্পের কাজ শেষে রোহিত হিমিকাকে বলল, “তোমার সঙ্গে কাজ করতে করতে আমার মনে হয়, আমি শুধু কাজ করছি না। আমি নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করছি। হিমিকা, আমি জানি না কীভাবে বলব, কিন্তু আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।”
হিমিকা চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে বলল, “আমি তোমার প্রতি কী অনুভব করি তা আগে বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি তোমাকে ছাড়া আমার জীবন কল্পনা করতে পারি না।”
সেই মুহূর্তে তারা অনুভব করল যে, তাদের বন্ধুত্ব এক নতুন রূপ নিয়েছে।
চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি
কিন্তু তাদের সম্পর্ক খুব সহজে এগোয়নি। রোহিতের পরিবার ছিল উচ্চবিত্ত, এবং তারা চেয়েছিল রোহিত একজন সমপর্যায়ের কারও সঙ্গে বিয়ে করুক। অন্যদিকে, হিমিকা ছিল এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে। তার বাবা-মা সমাজকর্মী হলেও, তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ছিল না।
রোহিতের মা একদিন তাকে ডেকে বললেন, “তুমি একজন ভালো মেয়ে পছন্দ করেছ, কিন্তু হিমিকা কি তোমার সঙ্গে মানাবে? তার জীবনধারা আর আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য তো এক নয়।”
রোহিত ধীর গলায় বলল, “মা, ভালোবাসার জন্য ঐতিহ্য বা সামাজিক মানদণ্ড জরুরি নয়। হিমিকা আমার জীবনের সেই অংশ যা আমাকে সম্পূর্ণ করে।”
অন্যদিকে, হিমিকার বাবা-মাও ভেবেছিলেন যে রোহিতের মতো ধনী পরিবারের ছেলে তাদের মেয়েকে মেনে নেবে কি না।
সংগ্রামের দিনগুলো
তাদের পরিবারকে বোঝানো সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু রোহিত আর হিমিকা একে অপরের প্রতি অটল ছিল। তারা তাদের সম্পর্ককে সময় দিয়েছিল, একে অপরকে আরও ভালোভাবে বুঝতে শিখেছিল।
একদিন তারা দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিল যে, তাদের ভালোবাসা প্রমাণ করার একমাত্র উপায় হলো তাদের কাজ। তারা সেই আবাসন প্রকল্পটি শেষ করল, যা এক হাজার পরিবারের জন্য নতুন জীবনের সূচনা করল।
এই সাফল্য তাদের পরিবারের মন বদলে দিতে শুরু করল।
একটি নিখুঁত পরিণতি
কয়েক মাস পর, রোহিতের মা একদিন হিমিকার সঙ্গে দেখা করে বললেন, “তুমি সত্যিই অসাধারণ। তুমি শুধু রোহিতকে নয়, আমাদের পুরো পরিবারকেই বদলে দিয়েছ। আমি এখন বুঝি, ভালোবাসার জন্য মানদণ্ডের দরকার নেই।”
হিমিকার বাবা-মাও খুশি হলেন এই দেখে যে, তাদের মেয়ে এমন একজনের ভালোবাসা পেয়েছে, যিনি তাকে সম্মান করেন।
অবশেষে, রোহিত আর হিমিকা তাদের পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করল। সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিল তাদের প্রকল্পের প্রতিটি পরিবার, যারা তাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল।
এক চিরন্তন গল্প
আজ, রোহিত আর হিমিকা একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। তারা শুধু নিজেদের ভালোবাসাকে স্থায়ী করেনি, বরং তাদের ভালোবাসাকে মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার একটি মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
তাদের গল্প প্রমাণ করে, ভালোবাসা কেবল একটি অনুভূতি নয়, এটি এমন একটি শক্তি যা জীবনের প্রতিটি বাধাকে অতিক্রম করতে সাহায্য করে।
ছবি – লেখক