হুম, উমম, আর শিমুল ঝড়ার মরসুম
এই নিয়ে ওদের আটহাজার তিনশো ঊনপঞ্চাশবার ব্রেকআপ। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো, খেতে পারতো না, ঘুমোতে পারতো না, কথা বলতে পারতো না ঠিকভাবে, মায় প্রকৃতির ডাক এলেও বোধহয় সাড়া দেবার প্রয়োজন বোধ করত না। আলুথালু বেশে, পাশবালিশটা আঁকড়ে ধরে শুরু হত ফোঁপানো; আর দফায় দফায় ফোনের স্ক্রিনে জুলজুলে চোখ… একটা মেসেজ! একটা ফোন!
ফোন আসত কয়েক ঘণ্টা পর। কখনও একক পালটে দিন। যথারীতি বাতিলের খাতায়। আবার ফোন, আবার একই। আবার, তারপর আবার…এভাবে বারকয়েকের পর বিরক্ত হয়েই রক্তিম গলায় প্রশ্ন-উত্তর, পাল্টা প্রশ্ন-প্রত্যুত্তরের পর্ব।
– কী?
– হুম।
– হুম কী?
– হুমকি।
– হুম।
– তুইও?
– আচ্ছা, উমম।
– উমম।
– আর না তো?
– না, প্রমিস।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নুইয়ে পড়া অভিমান আর তারপর উশকোখুশকো খুনসুটি। দিনের পর দিন। কখনও এমনও হয়েছে, সারাদিন ধরে, কখনও টানা দু’দিন ধরে সমানে চলেছে খিটমিটানি, মেটার নামটি নেই; অথচ, ঠিকঠাক খেল কিনা, ভালোভাবে পৌঁছলো কিনা সেসব খবর নখদর্পণে।
– লাভ রিয়্যাক্ট?
– তাতে কী আসে যায়?
– তাই? আচ্ছা।
– আবার কী হল?
– হুম।
– আবার! ধুর!
– এখন তো “ধুর” লাগবেই।
– কী মুশকিল!
– হুম, ঠিকই।
– আচ্ছা, সরি। তুলে নিচ্ছি।
– হুম।
– এখনও হুম?
– আগে তোল।
– নে, তুললাম।
– উমম।
– ঠিক আছে?
– উঁ।
– আর না বাবা!
– প্রমিস?
– প্রমিস।
ঝগড়ার কারণ বেশ সিরিয়াস। ফেসবুক ছাড়াও বাস্তবেও কখনও কখনও অন্য ছেলে বা মেয়ের দিকে উঁকি, কখনও অন্য কারোর প্রোপোজে নির্বিকার থাকা, আরো নানান উটুরেখুটুরে ব্যাপার – অত জেনে কাছ নেই। মোদ্দা কথা এই যে, স্থায়িত্বটা ঐ ঘন্টাখানেক, বেশি বাড়াবাড়ি হলে ঐ দিনদুয়েক। তিনদিনের দিন আঙুলে আঙুল রেখে ভিক্টোরিয়া বাঁধা একদম।
এইভাবে বছর সাতেক চললেও এইবার ব্যাপারটা বড়োই জটিল। এবারে একটা নয়, একসঙ্গে অনেকগুলো সমস্যা দানা বেঁধেছে। এবারে আর প্যাচআপ না প্যাকআপ কী একটা বলে সেই ব্যাপারটা হবে বলে মনে হয় না। রীতিমতো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি; বাবা-মাকে পর্যন্ত ময়দানে টেনে নামানোর পরিস্থিতি।
তা এমতাবস্থায় রাস্তা দুটো, হয় সর্বসম্মতিক্রমে নমঃ নমঃ করে বিদেয় হও অথবা, তোলঝাড়ানি ঝগড়া করে পারস্পরিক সম্মতিক্রমে বন্ধু হয়ে থাকো।
ওরা এসবের ধারেকাছেই গেল না, উল্টে ঝগড়ার বহর বাড়তে লাগল। রাত বাড়ে, ঝগড়া বাড়ে। রাত আরও বাড়ে, ঝগড়া ততোধিক পাল্লা দিয়ে বাড়ে।
শেষমেশ ভোরের দিকে এসে দুজনেরই মাথায় হাত! আজ ভোরে ওঠার কথা দুজনেরই। এক্ষুনি বাড়ির লোকজন চিলচ্যাঁচান চ্যাঁচাতে শুরু করবে। ঘুমের বারোটা। কী মুশকিল! অতএব আবার শুরু দোষারোপ, হুমকি আর কুরুক্ষেত্র; এবং . . . আটহাজার তিনশো পঞ্চাশ নম্বর ব্রেকআপ!
কে কাকে ঘুমোতে দিল না এই নিয়ে চলল খানিকক্ষণ। তারপর ডিমভাজার মতো মুখ করে দুজনেই খানিকটা জল খেয়ে বসে রইল গুম হয়ে।
ইসস, কী কুক্ষণে যে ঝগড়া করলুম, ব্যাটা সুযোগ পেয়ে দিলে ঘুম চটকে।
দাঁড়াও, আজ বিয়েটা হয়ে যাক! পরদিন থেকে দেখাচ্ছি, ঝগড়া কাকে বলে!
বিয়ে করেই ব্যাটাকে পুরো ব্রেকআপ দিয়ে দেব। গায়ের উপর পা তুলে নাক ডাকব যখন দেখব কেমন ঝগড়া করো তখন হুহ্।
আপাতত কী আর করা! যতক্ষণ না ডাকছে কেউ, শয়নে পদ্মলাভঃ! জয় মাহিষ্মতী!
অগত্যা, বিরক্তবদনে বিছানায় চিৎপাত।
– দুত্তেরি ছাই!
– ধুর! ভাল্লাগে না।
– সব তোর জন্য।
– ওরকম মনে হয়।
– দাঁড়া না, ক’টা দিনের তো ব্যাপার! তারপর, মজা দেখাচ্ছি।
– হুঁহ, আমি ছেড়ে দেব নাকি? মজা আমিও দেখাতে পারি।
– উফফ!
– ঘুমোলাম, টাটা।
– আমি বাথরুমে গেলাম, টাটা।
ওরা গেল যে যার কাজে। আর ঠিক সেইসময়ই হালকা মায়ামাখানো বসন্তের ভোরে শিশিরের কোলাহলে ওদের জানতে না দিয়ে কোনো এক অচিন মহানগরীর রাস্তার মাঝখানে একটা শিমুল টুপ করে খসে পড়ল।
ছবি-সায়ন্তনী নাগ