ডাইনিং টেবিলের ওপর সাদা ধবধবে ফ্রক পাতা। জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে টেবিলের ওপর। আর একটা পুতুল শুইয়ে রাখা, একদিকে ছুরি, আর একদিকে কাঁটা চামচ। পুতুলটা সিলিং-এর দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে। তার দিকে তাকাতে, দৃষ্টি আমার দিকে ঘুরে গেল। একই রকম নিষ্পলক। আসলে, আমি তার দৃষ্টি আর সিলিং-এর মাঝে এসে পড়েছিলাম। তারপর দেখলাম, আমি শুয়ে আছি সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে। একটা কাঁটা চামচ আর ছুরি ধাতব শব্দ তুলে ঘষে ঘষে কেউ শান দিচ্ছে।
স্বপ্নটার কথা বলেছিলাম, যতটা মনে ছিল। ওরা বলল, খবরের কাগজ কম পড়তে। খবরের চ্যানেল দেখা বন্ধ করতে। তারপর থেকে কয়েক মাস শুধু বিনোদনের পাতাগুলো রেখে যেত আমার ঘরে। বিকিনি পরা বিদেশিনীর ছবি। সিনেমা রিলিজের খবর। তারকা-সেলিব্রিটিদের ছবি। কমিক্স। এসব পড়তাম। পেজ থ্রী পার্টির উল্লাস দেখতাম খুব। চোখের তারায় ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলো ধরা পড়ে, কোনও কোনও ছবিতে বোঝা যায়।
মনে অন্য কোনও দুশ্চিন্তা বিশেষ আসত না। বোধহয় আসত না। তাও একদিন দেখলাম–
একটা গবলেট উলটে লাল ওয়াইন পড়ছে টপটপ করে। মেঝে দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে লাল স্রোত। একজায়গায় সেই লাল রঙ আরও ঘন। সেখানেও টপটপ করে পড়ছে লাল তরল। ক্রমশ ওপরে দৃষ্টি যেতে দেখলাম একটা মেয়ে ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে। তলপেটের কাছে ভিজে লাল হয়ে আছে। ওখান থেকেও পড়ছে টপটপ করে। রক্ত। বাথরুমের কল থেকেও এমন টপ টপ করে জল পড়ার শব্দ আসে, প্রতিধ্বনিত হয়।
বলেছিলাম… যতটা মনে ছিল। ওরা শুনে উদ্বিগ্ন হ’ল। ওষুধের নাম আর ডোজ পালটে দিল। জিজ্ঞেস করলাম– তোমরা স্বপ্ন দেখ না? দুঃস্বপ্ন দেখ না? তোমরাও এ’ভাবেই ওষুধ খেয়ে খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ রোজ? উত্তর পাই না… ঘুঘু পাখির ডাক ভেসে আসে।
ধর্ষণ আর মিসোজিনির কথা শুনতে শুনতে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। কথা নয়… খবর। শিশ্নগুলো যেন উঁচনো খাঁড়া, স্বয়ংক্রিয় উন্মুক্ত চপার… চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিকারের খোঁজে। উপযুক্ত চাঁদমারি পেলেই আমূল বিদ্ধ হয়ে যাবে। আর উপযুক্তই বা বলি কী করে? কাউকেই তো ছাড়ছে না। কুকুর-ছাগল- গোরুকেও না। রোজ এমন খবর, আর ধর্ষিতা নাবালিকার সাদা চাদরে ঢাকা লাশ, আর চোখ মেলে তাকাবে না– এসব দেখতে দেখতে একটা বিশাল সংখ্যক মানুষের মনে অপরাধবোধের কবন্ধ জন্মায় না? দুঃস্বপ্ন তাড়া করে না?
আমি জানি… অনেকেই গভীর রাতে ঘেমে ওঠে। মুখে চোখে জল দিয়ে আসে। সকালে উঠে আর কাউকে বলে না এসব। আমি বোকা… তাই বলে ফেলি। এবার থেকে কম বলব। বলবই না!
বার্নিনির সেই ভাস্কর্যটা মনে পড়ে খুব– Rape of Proserpina। প্রথমবার ছবি দেখে সীতা-হরণের কথা মনে পড়েছিল। তারপর ভাস্কর্যের নাম, শিল্পীর নাম জানলাম। আরও অনেক ছবি দেখলাম। সব থেকে বিস্মিত আর মোহিত করেছিল প্রোসার্পানার কোমল জঙ্ঘা আর কোমরে চেপে বসা প্লুটোর আঙুলগুলো! মর্মরকে এত কোমল রূপ দেওয়া যায়?! মনে হয়, আঙুলগুলো দৈবাৎ সরলেই ফুটে ওঠা কালশিটে দেখা যাবে প্রোসার্পানার জঙ্ঘা আর কোমরে। পাথরের ওপর কালশিটে পড়ে না। মানুষের শরীরে পড়ে… মনে পড়ে। আস্তারণ দিয়ে তাদের ঢেকে রাস্তায় বেরোই আমরা। পাশ দিয়ে রোজ কত প্রোসার্পানা চলে যায় তাদের কালশিটে নিয়ে!
রোমান দেবী প্রোসার্পানার গল্প জানলাম। এই হরণ বা ধর্ষণের গল্প জানলাম। জানলাম সেই বেদানার বীজগুলোর কথা। কেউ বলে – প্লুটো খাইয়ে দিয়েছিল। কেউ বলে প্রোসার্পানাই ইচ্ছে করে খেয়েছিল। একবার নরকের খাবার খেলে, সেখানে ফিরে আসতেই হয়। প্রোসার্পানাকেও ফিরে আসতে হ’ত বার বার। সহবাস করতে। ধর্ষিত হ’তে। সেই সব সহবাসের রাত নিয়ে অবশ্য কোনও ভাস্কর্য বা তৈলচিত্র দেখিনি। বোধহয় রোমান কিংবা গ্রীক পুরাণে সেসব নিয়ে আর কোনও গল্প নেই। অথবা, সহবাসের সেই সব ভাস্কর্য সৃষ্টি করতে সত্যিই দরকার কালশিটের দাগ। মর্মরের সীমাবদ্ধতা, শিল্পীর প্রতিবন্ধকতা। পাথরে কালশিটে পড়ে না। পড়ে?
একবার হাসপাতালে একটা বাচ্চা মেয়েকে ইনজেকশন দিচ্ছিল। দেখলাম, একটি লোক খুব শক্ত করে তার পাদু’টো ধরে আছে। চোয়াল শক্ত।
দেখে হঠাৎই প্রোসার্পানার কথা মনে পড়ে গেল। বলে ফেললাম– কালশিটে পড়ে যাবে যে!
লোকটি প্রথমে আমার দিকে না তাকিয়ে বলল– থামুন তো! আপনি বেশি বোঝেন?; তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘ইনজেকশনটা না দিলে চলবে?’
পরে জেনেছিলাম, লোকটি মেয়েটির বাবা। হাঁটুর নিচে যে আঙুলের ছাপগুলো বসে গেছিল তা নিয়ে কেউই বিশেষ চিন্তিত ছিল না।
ভাবলাম সত্যিই তো… আমি কি বেশি বুঝি? আমাকেও তো কত সময় কেউ না কেউ এমন শক্ত করে ধরেছে। আঙুলের ছাপও নীলচে দাগ হয়ে বসে গেছে। কত কাছের মানুষও ধরেছে কোনও না কোনও সময়… সেই ছোট্টবেলা থেকে!
চাঁদের গায়ে যে গহ্বরগুলো এতদূর থেকে ঝাপসা দেখি, একদিন ছাদে শুয়ে শুয়ে সেগুলোও কালশিটের দাগ মনে হ’ল। হয়ত, কোনও না কোনও লোককথা বা পৌরাণিক আখ্যানে চাঁদেরও ধর্ষিত হওয়ার গল্প পাওয়া যাবে। একটা নাইজেরীয় উপকথা মনে পড়ে গেল– যেখানে, চাঁদ মাঝে মাঝে এক দরিদ্রের কুটীরে আসত, নিজের শরীরের মাংস কেটে তার খাওয়ার ব্যবস্থা করবে বলে। তারপর একদিন সেই দরিদ্র পরিবারের মহিলা মাংস কাটতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল গ্রামবাসীর কাছে। চাঁদ পালিয়ে গেল, চিরকালের মত আকাশে। তাও মাঝে মাঝে চাঁদকে ছোটো হয়ে যেতে দেখা যেত। যেন কেউ খাবলে খাবলে খেয়ে নিচ্ছে। গ্রামবাসীদের স্থির বিশ্বাস ছিল, এখনও লুকিয়ে লুকিয়ে চাঁদের মাংস কেটে খাচ্ছে কোনও দরিদ্র পরিবার।
গায়ের মাংস কেটে খাওয়াচ্ছে কত চাঁদ! চোখের তলায় আর শরীরে কালশিটে নিয়ে।
আজ ইচ্ছে করেই চাঁদের কালশীটেগুলোতে চুমু খাব সারা রাত। আলতো আলতো চুমু। শুধু চুমু… ইচ্ছে করেই। প্রত্যাশাহীন পৌরুষ নেতিয়ে থাকবে সেডাটিভ খেয়ে। আর সকালে… নাহ্… সকালে কিছুই বলব না। অবেলায় ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে কারও কোনও উদ্বেগ নেই। বরং, বেঁচে যায়
ছবি – পিকাসো