প্রতীকী ছবি

সে ছিলো এক মস্ত শরীরের মানুষ, লাল রঙের ধুতি, প্লাস্টিকের গঙ্গাজলের ঘটি সদৃশ্য কৌটো কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা, পলতার গঙ্গা থেকে স্নান সেরে ও পথেই হেঁটে হেঁটে সে তারাপীঠ পর্যন্ত যাবে। আমরা স্কুল ফেরত ক্লাস সেভেনের দল, আগে কখনো অমন প্রকাণ্ড শরীরের কাউকে শুধুমাত্র লাল ধুতি আর গামছা মতো কিছু একটা গায়ে জড়িয়ে পথ চলতে না দেখায় স্কুলের সামনের বাসস্টপে তাকে জিরোতে দেখে আমরা তার কাছে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছো? উত্তর এলো কোথাও যাচ্ছি না। বললাম, কোথাও না গেলে চলেছ কেন? তখন বললো, তারাপীঠ যাচ্ছি। বললাম, এই যে বললে কোথাও না! হেসে উত্তর দিলো, তারাপীঠ তো সত্যিই কোথাও না, ও তো মনের থেকে মনের দিকে যাওয়া। আমার সাথে বাকি যারা ছিলো তারা অনেকক্ষণ হলো সরে গেছে, আমিই ছিলাম শুধু, কিন্তু আর না। এর সাথে আর কথা বলা চলে না, এমন করে কেউ কথা বলে! এর থেকে চৈত্রের সন্ন্যাসীরা অনেক ভালো, অন্তত তারকনাথের নাম করে ডাক তো দেয়! যে সব ডাকের কোন অর্থ থাকে না ডাক থাকে শুধু, এখন মনে হয় তাদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলে হতো, কিন্তু কোথায় আর যাওয়া! গন্তব্য ফুরিয়ে যাবার ভয়ে কখনো কখনো মনে হয় চৈত্রের সন্ন্যাসীরা তীব্র রোদে ঘর ছাড়লেও ঘরের ঠিকানা কেন ছাড়তে পারলো না। এই না ছাড়া কি ঘরের সাথে তাঁদের বন্ধুত্ব আছে বলে!  না পথের শেষে তাদের কারোর না কারোর কাছে পৌঁছানোর আছে বলে? পৌঁছে গেলেই যাত্রা শেষ, তখন ঘর ছেড়ে কোথায় আর যাবে মানুষ! চৈত্র ফুরিয়ে আসে, তারকনাথের নাম মিলিয়ে যায় বাতাসে, গ্রামের প্রান্তে গাজনের শব্দ জেগে ওঠে, কাঁটায় হেঁটে, আগুনে ঝাঁপ দিয়ে যাঁরা সন্ন্যাস দিনের পরমার্থকে খুব কাছের থেকে দেখছে, তাঁদের মুখ মনে পড়লে মনে মনে ভারী হিংসে হয়। এইসব প্রপঞ্চ পীড়িত জৈবিক তাড়ানায় সন্ন্যাসীকে হিংসে করাও পুণ্য বলে বিবেচিত হয় বলে একদিন সরল করে চাইবার আনন্দ পথের প্রান্তে এমন করে ছড়িয়ে গেল! যাঁদের কোন সম্প্রদায় নেই, আখড়া নেই, শুধু ঘর থেকে বাইরে বেরোনোর ডাক আছে, তাঁদের ঘরের প্রতি বন্ধুত্বও আছে বলে কি কৃচ্ছসাধনে একবারেই মনের সুখ খুঁজে নেওয়া? বহুদিন হয়ে গেলেও চাষের মাঠের চরিত্র তেমন বদলায় নি, যেহেতু একদম মাঠের মাঝখান থেকে হাইভোল্টেজ তারওয়ালা উঁচু উঁচু টাওয়ার গুলি চলে গিয়েছে তাই ওদেরই একটার নীচে যেমন বসবার মত অনেকখানি জায়গা পাওয়া যায় তেমনি আশেপাশের মাঠ ধান বা পাটে ভরে উঠলে দূরের রাস্তা থেকে আমাদের আর আর দেখা যায় না। স্কুল আজকের মতো শেষ, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। সাইকেলের তালা খোলবার খুট্ করে শব্দটা হতেই ব্যাগে হালকা টান, এর অর্থ কিছুই না, আমাকে সেই মাঠটাতে যেতে হবে, আমার বন্ধুরা ওই দ্বীপের মতো ফসলের পরিখা দিয়ে ঘেরা টাওয়ারটিকে দুর্গ বানিয়ে ফেলেছে আর আমি তার প্রহরী। ওদের মুখের ধোঁয়া যতক্ষণ না মিলিয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ আলের মাঝে একলা ঘুরতে ঘুরতে মনে হতো এও একপ্রকার স্বনির্মিত সন্ন্যাস। ওরা কেউ আমাকে জোর করেনি, শুধু ওদের ডাকে সাড়া দিইনি বলে ওদের আশে পাশেই রয়েছি কিন্তু কী এক টানে ওদের ছেড়ে যেতে পারিনি, একেই কি বন্ধুত্ব বলে? বন্ধুরা কখনো একসাথে বুঝি সন্ন্যাসী হতে পারে না? একমাসের উন্মাদনা ধীরে ধীরে এই অদ্ভুত সংক্রান্তির রাত থেকেই শান্ত হয়ে আসতে থাকে, আজ রাতেই লৌকিক দেবতা শয়ন করবেন, দেবলোকের বর্ণশ্রেষ্ঠদের সাথে তাঁর এখন ভালোই ভাব, কেউ কাউকে অপদস্থ করেন না, বৈশাখের প্রথম দিন থেকে পরবর্তী বছর পর্যন্ত মাঝে মাঝে এখন ওঁরা একসাথে পুজো নেবেন, যাঁরা সন্ন্যাসী ছিলেন তাঁদের কেউ কেউ লাঙল হাতে মাঠে ফিরবেন, কেউ টোটোর হাতলে হাত রাখবেন, কেউ রাজমিস্ত্রি কেউ বা মাছধরার কাজে, শুধু শেষে পড়ে থাকবো আমরা। আমরা ভোগ করাও শিখলাম না তাই ত্যাগও হলো না, শুধু ‘কোথাও যাওয়ার নেই’ এই কথা শুনতে শুনতে মনের চারদিকে দরজা গড়ে উঠলো। স্কুলের দিনের সন্ন্যাসী, এবার তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন! মন থেকে মনের দূরত্ব ঠিক কতখানি?

 

ছবি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By সৈকত বালা

বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের শেষ প্রান্তে জন্ম, বাংলাভাষার কবিতা এবং বাংলার ইতিহাসের আগ্রহী পাঠক।

Leave a Reply