একজন মানুষ। একা মানুষ। পুরুষ মানুষ। সংসার আছে। বউ আছে, মা আছে, কন্যা আছে, পূত্র আছে। বাড়িতে দুটো গরু আছে। উঠোনে একটা নিম গাছ আছে। তাঁর নিচে তুলসীগাছ আছে।
একসময় ইলেকট্রিকের কাজ করতো। অনেক পয়সা ছিল, পাশবই ছিল। এখন বাজারে ফল বিক্রি করে। ঝুড়ি নেয়, লুঙ্গি পরে, গামছা নিয়ে যায় স্টেশনের দিকে.. । কখনো মনে হলে একটা প্লাস্টিক মদ খেয়ে নেয়। আরাম পায়।
কালীর দোকানে এসে, শিব দেড়শো পান গালের মধ্যে ঢুকিয়ে ভেন্ডার বগীতে ওঠে। ফলপট্রী যাবে, বড়োবাজার। আলুথালু হয়ে বসে নিচে।
ছেলেটার আজ রেজাল্ট বেরোবে, মাধ্যমিকের। আজ একটু ভালো মন্দ নিয়ে যাবে। মেয়েটার জুতো নষ্ট হয়ে গেছে। সকাল পাঁচটার সময় ঘুম থেকে উঠে গনেশ, পায়খানা যায়। দূর রাস্তার ধারে। কেউ কেউ কখনো সখনো বকেছে, বাইরে পায়খানা করে বলে। কোনো পাত্তা দেয়নি। আসার সময় নিম দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজা হলে, বাড়িতে এসে ওয়াক ওয়াক করে বমি করে, জল ছাড়া কিছু বেরোয়না। তখন মেয়েটা সাইকেল নিয়ে কোচিংএ যায়। জুতোটা তখন দেখেছে, একদম নষ্ট হয়ে গেছে। তাই একটা জুতো কিনতে হবে। আজই কিনে নেবে। মায়ের প্রেসারের বড়ি নিতে হবে। মা বলেছিল, খোকা আমার বড়িটা নিয়ে আসিস, আর কটা দিন বাঁচবো।
বাবা মরে যাওয়ার পর, মা কেমন একা হয়ে গেছে। ননির চা দোকানে চা খেতে গেলে, বাবার কথা আলোচনা হয়। ননির ভাই বলেছিল -গনেশদা, কাকা আরো কিছুদিন বাঁচতো। বউদি যত্ন করলো না। আর একজন পাশ থেকে বলল, “বুড়ো মানুষ তাঁকে মারতো। বলত, মর মরতেও পারিস না। এতো লোকের মরণ হয়… ”
নিজের মনে বিশ্বাস করতে পারতো না গনেশ। কি সব বিড় বিড় করতে করতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিত। বাড়িতে এসে বললে কেউ মানতো না। ছেলে তাঁর মাকে বলতো, ননির দোকানে কেউ যায়। ওটাতো মির্চির অপিস। সব জানা যায়।
ট্রেন ছুটছে মাঠের পর মাঠ পার হয়ে। গনেশ বিড়ি ধরায়। পাশে বসে থাকা এক দাদা তাস দেখিয়ে বলে হবে নাকি? গনেশ মাথা নেড়ে না জানায়। একজন হকার ওঠে কড মাছের হাড় নিয়ে। সব ব্যাথা ভালো হয়ে যাবে…
পরের স্টেশন থেকে মদন দা ওঠে, ও গনেশ দা চেপে বসো। ধপাস করে বসে পড়ে। নানারকম কথা হয়। মদনদা ও ফল ব্যাবসা করে।
আর কিছু দিন পর বাঙালির শ্রেষ্ঠ পুজো শুরু হবে। বাড়িতে বাড়িতে ছেলে-মেয়েরা মদ খাবে। তখন কেউ কিছু বলবে না।গনেশ দা ভাবে, তার ছেলে যেন এসব না শেখে। তখন কত খরচ। এখন ব্যাবসা টা মন দিয়ে করতে হবে। কামাই করলে হবে না। দিন দিন খরচ তো বেড়েই চলেছে।
পাশে মদন দা ঢুলে পড়ছে। গনেশ চা খায়।
স্টেশন আসে রোজকার। নেমে বাস ধরে চিৎপুর। আজ কমলালেবু তুলেছে। এদিক ওদিক বাজারে বিক্রি করে।
মেয়ের জুতো, মায়ের ঔষধ, কিছু ফল আর পাঠার মাংস নিয়ে নেয়। আজ ভালো ইনকাম হয়েছে।
আবার যথারীতি ট্রেনে ভেন্ডারে ওঠে। খুব গরম হচ্ছে। এই ট্রেন টা ধরবে বলে অনেক দৌড়ে এসেছে। ঘাম দিচ্ছে। দরজার সামনে বসে। ভালো হাওয়া দেবে। বাঁশি বাজিয়ে গাড়ি সামনের দিকে এগোতে লাগলো।
আজ আর নিতাইএর কাছে মদ খেতে যাবে না। ছেলের রেজাল্ট বেরিয়েছি। কি হয়েছে? নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। আমার ছেলে বলে কথা। আমার পড়াটা হল না। তা বলে আমার ছেলে মেয়েরা পড়বে না।
আজ ছোটো কাকার কথা খুব মনে পড়ছে। কাকা রাজনীতি করতো। তখন গনেশ নাইনে পড়তো। একদিন সন্ধে বেলা মুচি পাড়ার ছেলেরা এসে বাবাকে বলছে, ও দাদা এসো এসো তোমার ভাই পড়ে আছে ধান মাঠে। আমরা ছুটে যাই…। রক্তাক্ত, মাথার ঘিলু বেড়িয়ে গেছে। কাকা বেঁচে নেই।
গনেশ বমি করে ওঠে, কাকার সেই দৃশ্য মনে করে…
খুব জোর একটা আওয়াজ হয়। ট্রেনে উপস্থিত সকলে চিৎকার করে ওঠে। যাদের চোখে ঘুম এসেছিল, তারা হাঁ করে দেখে। জলজ্যান্ত মানুষ টা ট্রেন থেকে পড়ে গেল। শুধু ট্রেনের মধ্যে পড়ে রইলো, জুতো মাংস ফল ওষুধ। ঝুড়ির মধ্যে। কিছুটা এসে ট্রেন থামে।
শেষ বারের মতো, আর কেউ থামবে না গনেশের জন্য।