কাশীর বাঙালি নববর্ষ: প্রাচীন ঐতিহ্যের আধুনিক ছোঁয়া
প্রথম বৈশাখের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কাশীর বাঙালি পাড়াগুলো যেন নতুন প্রাণে ভরে ওঠে। নতুন বাংলা পঞ্জিকা খুলে দেখা হয় শুভ দিনক্ষণ, বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো হয় রঙিন ক্যালেন্ডার। সকাল শুরু হয় মিষ্টিমুখ দিয়ে – রসগোল্লা, পান্তুয়া আর নারকেলের নাড়ুর স্বাদে ভেসে যায় পুরনো বছরের সব ক্লান্তি।
পরনে আসে বাঙালিয়ানার প্রতীক – খাঁটি সুতির ধুতি-পাঞ্জাবি আর মিহি শাড়ির ঝলক। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে নতুন ব্যঞ্জনের সুবাস – ইলিশের টক, চিংড়ির মালাইকারি আর পোলাওয়ের গন্ধে মাতোয়ারা হয় বাড়ির আঙিনা।
প্রণাম জানানো হয় গুরুজনদের, দূরের আত্মীয়-স্বজনদের ফোন করে শুভেচ্ছা পাঠানো হয়। যাদের সঙ্গে সারা বছর দেখা হয় না, নববর্ষেই যেন ফিরে পাওয়া যায় সেই হারানো সম্পর্কগুলো। বাড়ির দরজায় টাঙানো হয় আমপল্লব আর কদমফুলের মালা, কোথাও আবার মঙ্গলঘট স্থাপন করে সিঁদুরের টিপ দিয়ে লেখা হয় “হালখাতা”।
পূজার ঘরে স্থাপন করা হয় লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তি, পাঠ করা হয় চণ্ডীপাঠ। এই সব ঐতিহ্য আজও কাশীর বাঙালি পরিবারগুলো অক্ষুণ্ণ রেখেছে। নববর্ষ এখানে শুধু উৎসব নয়, এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত এক জীবন্ত সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতি কাশীর মাটিতে মিশে আছে গঙ্গার স্রোতের মতোই অবিচ্ছিন্নভাবে।
কাশীর বাংলা ফলক: হারিয়ে যাওয়া এক ভাষিক ঐতিহ্য:
আজকের দিনে যখন বাড়ি-ঘর ও প্রতিষ্ঠানের ফলকে স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি লেখার চল দেখা যায়, তখন কাশীর পুরনো গলিগুলো ঘুরলে চোখে পড়ে এক ভিন্ন ইতিহাস। উনিশ শতকের বাঙালি টোলা (যা এখনকার অবস্থান থেকে ভিন্ন জায়গায় ছিল) থেকে শুরু করে পনেরো-সতেরো শতকের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বাংলা হরফে লেখা ফলকের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ছিল।
ইতিহাসের সাক্ষী:
চৈতন্য দেবের পদধূলি পড়া সেই পথ থেকে ঠাকুর পরিবার, জমিদার গোবিন্দ মিত্রের প্রাসাদ, এমনকি বাল্যবিধবা মল্লিকার বাড়ির ফলক পর্যন্ত – সবেতেই বাংলা অক্ষরের ছাপ ছিল লক্ষণীয়। আশ্চর্যের বিষয়, অনেক অবাঙালি পরিবারের বাড়ির ফলকেও বাংলা লিপি ব্যবহার করা হতো, যা কাশীর সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের এক অনন্য উদাহরণ। আজও হেরিটেজ জোনে ঘুরলে কিছু পুরনো বাড়ির গায়ে সেই বাংলা খোদাই করা ফলক চোখে পড়ে।
ভাষার মেলবন্ধন:
এসব ফলক শুধু নাম-ঠিকানা নয়, ছিল এক যুগের সামাজিক প্রেক্ষাপটের দলিল। যেখানে:
– সংস্কৃত টোলের পণ্ডিতদের বাড়িতে বাংলা-সংস্কৃত মিশ্র লিপি
– মারোয়ারি ব্যবসায়ীদের দোকানে বাংলা সংখ্যা
– স্থানীয় প্রশাসনিক ভবনে তিন ভাষার সমন্বয় (হিন্দি-বাংলা-ফারসি)
অন্তঃপুরের ইতিহাস:
বিশেষত নারীসমাজের সাক্ষরতার নিদর্শন হিসেবে বাল্যবিধবা মল্লিকার বাড়ির বাংলা ফলক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। যেখানে সাধারণত নারীদের নাম প্রকাশ্যে লেখা হতো না, সেখানে “শ্রীমতী মল্লিকা দেবী”-র মতো ফলকগুলি সেই সময়ের সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করত।
বর্তমান পরিস্থিতি:
আজকের কাশীতে এই ঐতিহ্য ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। নতুন ভবনগুলিতে বাংলার পরিবর্তে হিন্দি-ইংরেজি ডোমিনেন্ট। তবে কিছু পুরনো বাড়ি, যেমন ঠাকুরবাড়ি বা মিত্র প্রাসাদের গায়ে এখনও জীর্ণ বাংলা অক্ষরে লেখা “শ্রীগোবিন্দ মিত্র ভবন”-এর মতো ফলকগুলি অতীতের সেই বহুভাষিক কাশীর স্মৃতি বহন করে চলেছে।
সংরক্ষণের আহ্বান:
ভাষাবিদ ও স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, এই বাংলা ফলকগুলি শুধু শিল্পকর্ম নয়, কাশীর ৫০০ বছরের বাঙালি বসতির মৌখিক ইতিহাস। ঐতিহ্য রক্ষায় প্রয়োজন:
১. পুরাতন ফলকগুলির ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন
২. হেরিটেজ বিল্ডিং সংরক্ষণ আইনে বাংলা লিপির ব্যবহার বাধ্যতামূলক
৩. স্থানীয় মানুষদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি
কাশীর গলিতে গলিতে ছড়িয়ে থাকা এই বাংলা অক্ষরের স্মারকগুলি যেন বলে চলেছে: “এখানে একদিন বাংলা কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়েছিল, যার প্রতিধ্বনি এখনও সম্পূর্ণ মিলিয়ে যায়নি।”
কাশীতে বাঙালির বসতি ও বাণিজ্যিক প্রভাব :
কাশী বা বারাণসী শুধু একটি আধ্যাত্মিক নগরীই নয়, এটি ছিল প্রাচীন ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। বাঙালির সঙ্গে কাশীর এই যোগসূত্র কেবল ধর্মীয় নয়, বরং তার মূলে রয়েছে গভীর বাণিজ্যিক ইতিহাস। বঙ্গদেশের রাজা শশাঙ্কের সময় থেকেই এই সম্পর্কের সূচনা। সেই যুগ থেকে আজ অবধি বহু বাঙালি বণিক ও পণ্ডিত কাশীতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন। তাদের অনেকের বংশধররা এখনো কাশীর সমাজ ও অর্থনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত।
প্রাচীনকালে গঙ্গা নদীপথে বাণিজ্যের জন্য কাশী ছিল একটি প্রধান কেন্দ্র। বাংলার মসলিন, রেশম, চিনি এবং নানান শিল্পজাত পণ্য এখানে আসত। বাঙালি বণিকরা কাশীতে নিজেদের ব্যবসায়িক কুঠি স্থাপন করেছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা এখানকার সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন। আজও কাশীর বিভিন্ন ফলকে, বিশেষত গোদৌলিয়া ও বিশ্বনাথ গলিতে, বাংলা হরফে লেখা দোকানের ফলক চোখে পড়ে। এগুলি সেই বাঙালি পরিবারগুলির স্মারক, যারা শতাব্দীকাল ধরে এখানে বসবাস করছেন।
কাশীতে বাঙালির প্রভাব শুধু বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এখানকার সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং ধর্মীয় জীবনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। অনেক বাঙালি পণ্ডিত কাশীতে এসে সংস্কৃত চর্চা করেছেন, আবার অনেক সাধক এখানকার আশ্রম ও মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এমনকি আজও কাশীর বহু মন্দির ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষায় পূজা ও আলোচনা হয়।
আজকের দিনেও কাশীতে বাঙালিদের একটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায় বাস করেন। তারা স্থানীয় সমাজের সঙ্গে মিশে গেলেও নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ধরে রেখেছেন। দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজার মতো উৎসবগুলি এখানে বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ী পালিত হয়। কাশীর বাঙালিরা শুধু প্রবাসী নন, বরং তারা এই নগরীরই অংশ। তাদের উপস্থিতি কাশীর বহুত্ববাদী চরিত্রকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
এই দীর্ঘ ঐতিহাসিক সম্পর্কের ফলে কাশী ও বাংলার মধ্যে গড়ে উঠেছে এক অনন্য সাংস্কৃতিক সেতু। বাণিজ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির এই মেলবন্ধন আজও প্রাণবন্ত। কাশীর গলিতে বাংলা ভাষার গুঞ্জন, মন্দিরে বাংলা মন্ত্রের ধ্বনি, আর বাজারে বাংলা হরফের দোকান—এসবই সেই অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের সাক্ষ্য বহন করে।