অনিন্দিতা মণ্ডলের কবিতা

ছাদ

গোটা ছাদ জুড়ে লেগে থাকে নুনের দাগ । অ্যান্টেনার গায়ে অস্পষ্ট শিলা বৃষ্টির সময় আঁকা। এ কোণ থেকে অন্য কোণ বাঁশে লাগান দড়ির উপর লাল নীল সবুজ সুতোর পুরাতন গল্প। খোলা আকাশের নিচে যে রোদ এসে পড়ে নোনানো চালে ওই রোদ‌ও আবছা হয়ে যায় মায়ের হাসি মুখের কাছে। চালেদের গায়ে নুনের থেকেও বেশি লেগে থাকে মায়ের হাতের গন্ধ, গোপন তৃপ্তি। মা শালিক পাখির দল দূর থেকে দেখে নেয় পাহারাদারের ঘুম চোখ। সুযোগ বুঝে ঝাঁকে এসে খুঁটে খেয়ে যায় খুদা নিবারণের দানা। বাচ্চা শালিকের জন্য নিয়ে যায় এক দুটো নোনতা চাল। এমন দৃশ্যের পরেও একমাত্র মা হলেই বোঝা যায়, একছাদ এলিয়ে
শুয়ে থাকা রোদ্দুরের মতন দীর্ঘতম সুখী দুঃখ।

 

জানালা

ঘুম থেকে জেগে ওঠে তালপাতার পাখি, ফুড়ুৎ করে পালিয়ে যায় জানালার তৃতীয় রডটার নিচে দিয়ে। ওই অংশটা সবাই কেন এত পছন্দ করে কে জানে; কেউ পালিয়ে যায় আবার কেউ প্রবেশ করে। চাঁদের আলো ধোয়া মানভঞ্জন পালাগান সুরসুর করে ঢুকে পড়ে পাতলা হাওয়ার সাথে। মেঘলা আকাশে টহল দিয়ে বেড়ায় বৃষ্টিপ্রেমী পাখি, ফসল ওঠা মাঠের উপর ফসলের গোড়া একা একা কেঁদে চলে । চাঁদ থাকব থাকব করে হারিয়ে যেতে থাকে ভোরের আলোয়। বালিশের পাশে ডেকে ওঠে জ্যোৎস্না রঙের তালপাতার পাখি। অন্ধকার কমে এলে, জানালার উল্টোদিকের দেওয়ালে ঘুমের ছায়া আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে।

 

বারান্দা

পুরোনো বেতের মোড়া। দল বেঁধে বসে থাকার লোভ। চোখের সামনে একটা মাকড়সা লালা দিয়ে সমস্ত স্মৃতি এক জায়গায় করছে; কেচ্ছা, কেলেঙ্কারি, গুজব। এইসব নিয়ে রাতে ঘুমোতে
যায় কবি। চড়ুই পাখির পালক জমানো ছোট্ট জায়গাটা হয়ে
ওঠে চড়ুই পাখির সিন্দুক ঘর ওখানে জমানো থাকে তার প্রজন্ম। নিয়মিত কয়েকটা চায়ের কাপ, চুমুকের শব্দ। একটা বিস্কুটের গন্ধ খুঁজতে এসে প্রতিদিন নতুন নতুন বিস্কুট জমিয়ে লাল পিঁপড়ের শীতকাল হয়ে ওঠে বৈচিত্রময়। যতবার একা একা কাঁদতে এসেছে, ততবার চড়ুই পাখি আর লাল পিঁপড়ের ভিড়ে হারিয়ে গেছে মাকড়সার তৈরি স্মৃতি প্রচ্ছদ।

 

উঠোন

কত কত আলপনা, পায়ের ছাপ বুকে করে নিয়ে পড়ে থাকে। আকাশের কাছে বুক ফুলিয়ে আম বকুল ঢাকা মুখ দেখতে চেয়েছিলাম যতবার, ততবার প্রত্যাখ্যানে ভরে গেছে মুঠি। মুখ,
চোখ ঢেকে গেছে বৃষ্টি তে। নব্বই সালের ডাকাত দলের রক্ত পিঠজুড়ে মৌচাকের মৌমাছির মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। পুনর্জন্মের পর পুনর্জন্ম। এখানেই থেকে গেছে সব্বাই। জ্বর ধোয়া জল, কাঁচা মাংস ধোয়া জল, তুলসী পাতা ধোয়া জলে হয়ে ওঠে শুশ্রূষা ও পবিত্র। যে ধান মড়াই এ ওঠে তার কাছে রাখা থাকে সোনালী ঝরা পাতা। মড়াই এর বুক ফালাফালা হলে তার বুকের ভিতর থেকে উঠে আসে অবিকল উনুন পোড়ার গন্ধ। মা সুনিপুণ হাতে সারিয়ে তোলে ক্ষত, সাজিয়ে দেয় গোলাজলে, আলপনায়।

অথচ, প্রলেপের উপর আবার দীর্ঘ হয় ক্ষতচিহ্ন। আর সেই ক্ষতে আটকে যায় সদ্য মৃতার উদ্দেশ্যে ছড়ান খই।

 

দরজা

মানুষের থেকেও বেশি কালো শুঁয়োপোকা আর কেন্নোর আনাগোনা। বিপদের আশঙ্কায় হনুমানের ছবি ঝড় জল বজ্রপাতে ঠিক রঙহীন হয়ে ঝুলে আছে। অবিশ্বাস মিশলেই নাস্তিকের দেওয়াল থেকে খসে পড়বে। বর্ষার জলের ঝাপটায় চৌকাঠ, সিঁড়ি কানায় কানায়। বামুন ঠাকুর বলে, বৃষ্টিরা ছুঁয়ে গেলে লেগে থাকে বরুণ দেবের করুণা। এইতো পথ। হোঁচট। আনাগোনা। আগমন। বিদায়। দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকে নববধূ। তার কাছে তো ঘর নয় অর্ধেক পৃথিবী। হোঁচট খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে যায় চৌকাঠে আনাগোনা। এত আনাগোনা, আগমনের মাঝে বড় হয়ে ওঠে বিদায়। মা বলে, কেউ দরজা থেকে বেরিয়ে গেলে তার মুখের ওপর দরজা এঁটে দিতে নেই। বিদায় সুন্দর, যদি পিছন ফিরে সে দেখে তারজন্য দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

 

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By অনিন্দিতা মণ্ডল

জন্মগ্রহণ করেন ২৯ জুন ২০০১, বাঁকুড়া জেলার কাঞ্চনপুরে। ফুল বাগান তৈরি করা একপর্যায়ে নেশা তাঁর। বই পড়তে ও ছবি তুলতে ভালবাসেন।

Leave a Reply