দোলা
মাতৃগর্ভে ভ্রুণ দোল খায়, ঘুম আসে ঘুম যায়- বেলা পড়ে এলো, দিনমণি স্থির হও, আকাশ গঙ্গায় নেমে ঝুড়ি ভর্তি তারা তুলে আনে বুড়ি। হাঁটুর ওপরে তার কাপড় গুটানো, ঘুম আসে ঘুম যায়- বেলা পড়ে এলো।
পথের নিশান আছে পথেতে বিছানো, শহীদের বেদী থেকে কিছু দূরে খেলা করে শিশু।অনেক দূরের পথে আলোছায়া পার করে রাতে লড়ি আসে, লড়ি যায়, অনেক অনেক মাল লরিতে চাপানো ।
শহর গ্রামের মাঝে কাপাস গাছের ডালে ভেঙ্গে পরে তুলো। ঘুম আসে, ঘুম যায়-বেলা পড়ে এলো।
রাতের উদোম নারী, সহচরী বারো হাত শাড়ি নদীতে ভাসিয়ে দেয় । দেহ ভান্ডে রাঁধা হয় তরিতরকারি কারোর খবরদারি চলেনা এখানে, রাত আসে রাত যায়, দাওয়ায় ঘুমিয়ে থাকে ক্লান্ত পথচারী ।
আকার-বিকার থেকে দিনের প্রহরী- চুরি করে নুন গাছ, বসন্তের রাতে জ্বলন্ত হাতির পাল আছড়ে পড়ে স্রোতে, ছিটকে ওঠে ঘিলু, নাসারন্ধ ভেদ করে দেখা দেয় অবারিত ফনা, ঘুম আসে ঘুম যায়- বেলা পড়ে এলো।
জনরোষ
প্রথম যেদিন আমি লিঞ্চড হলাম সেইদিন প্রতিটা চপেটাঘাতের মধ্যবর্তী ক্ষণিকায় সে আমাকে পেয়ে বসে। নতমুন্ডমস্তক প্রচন্ড এক অঙ্গছেদের আবহে, আমি প্রাণবস্তু ভেবে আকড়ে ধরি চশমা , মানিব্যাগ । খতনার খুড়ের ধার মানুষকে বৈধভাবে দ্বিখন্ডিত করে, আমাকে করলো ঈর্ষাকাতর। আমি বিলম্বিত লয়ে উঠে বসি, চারিদিক দেখি, ট্রেন থেকে নেমে যাই একা। হিন্দু গৌরবের এই দেশে, খতনার উপমাটা বিপদজনক। তবু কি এক আলস্যে আমি প্লাটফর্মের দেওয়ালে ভর দিয়ে অনুকম্পাহীন চেয়ে থাকি-চলমান ঐ ট্রেনটার দিকেই।
চক্র
সঙ্কোচ ত্যাগ করে সে যখন বহুগামী হলো তখনও পূর্ণিমার চাঁদ মধ্যগগনে অধিষ্ঠিত। সে তার গোপন দুটো ভ্রমর স্ব-ইচ্ছায় তুলে দিলো এক প্রকৌশলী ও এক ব্যর্থ কবির তত্ত্বাবধানে। অথচ তার হাঁ মুখ যোনি অফুরন্ত বিস্ময়ে চেয়ে রইলো পায়ে হাঁটা পথের দিকে । এই পথ ধেয়ে পশুরা জল খেতে নামে। তিনজনের হাতে হাতে ঘুরছিল তোবড়ানো স্প্রইটের বোতলে কড়া দিশিমদ, যা তারা তুলে ধরেছিল শূন্যে- ঐ একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, অচেনা সরীসৃপের নড়াচড়া- সবকিছু অগ্রাহ্য করে। তারা লেহন করেছিল পরস্পরকে। তারা এলাকা দখলের কায়দায় পেচ্ছাপ করেছিল সশব্দে, পাশাপাশি । এত অব্দি শুনে আমি আদিম কুলপতিদের ভঙ্গিমায় নতমুখ মেঘদল হয়ে ভেসে যেতে চাই । আমার বলিরেখা ঝাপসা হয়ে আসে, চোখ ঘোলা হয়ে যায়, চুল পাতলা আঁশের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে মিশে যায় চিরায়ত স্রোতে। ঠিক এমন সময় টুনটুনি রোমাঞ্চের নির্জন মুখের দিকে চেয়ে জানতে চায়, “বাছা তুমি উঠতে পারো?” ভোরের রোমাঞ্চ বরাবর সপ্রতিভ, মাথা নেড়ে নেড়ে বলে ওঠে, “হ্যাঁ মা, এই দেখ। “
দুর্বাসার হাসি
যদিও সঙ্কোচ ততখানি সঙ্কুচিত নয়, অবোধ রোমাঞ্চে বোধবুদ্ধির আসকারা কিন্তু স্পষ্ট। ভাষা তাকে প্ররোচিত
করে। আর সে ভাষাকে ব্যবহৃত খেলনার মতন ছুঁড়ে ফেলে অদৃশ্য দেওয়ালে, নালায়। আমাদের গাছ, পাখি, কুকুরের ছানা সেইসব টুকরো টুকরো ভুল মুখে তুলে নেয়। দূর আকাশের বুকে অক্টোপাস, জেলিফিশ মিটমিট করে ।
সঙ্কোচ রাত্রির অন্ধকার ভালোবাসে। ভালোবাসে পুঁথি ও পুরাণ। তাকে মহাপ্রলয়ের কথা বলি। বলি প্রলয়ের
আগে যে ছিল অভাগী, ম্রিয়মাণ, পরের সকালে সে তার প্রতিষ্ঠা অবশ্যই খুঁজে পাবে। তবে এসব গল্পের মাঝপথে রোমাঞ্চ আচমকা কামড় বসায় । তার খুঁদে দাঁতে রক্তের নুন, হাসির থেকেও সাবলীল লাগে।
ভুত
পরিযায়ী দিন আমাদের কারচুপি করে এনেছে বাগানে। ভুতের কারবার হবে অথচ ধনুক তীর, চামড়ার ব্যাগ কিংবা খাঁচা, কিছু নেই। আমি ও রোমাঞ্চ তবু ওত পেতে বসে থাকি ভুত ধরবো বলে । রোমাঞ্চ চেনেনা ভুত। গায় তার ছেঁড়া গেঞ্জি, মাথায় পালক। ভয় পেলে হেসে ওঠে, করতালি দিয়ে খালি প্রজাপতি প্রেতেদের চমক লাগায়। বালক বাতাস এসে তার সাথে খেলা করে, সে ভাবে ভুত বুঝি পুকুরের ঢেউ। ঘুমন্ত শামুক হাঁটে অতি শ্লথ, ভাঙা দেওয়ালের গায়ে বসে বুড়ো ঘুঘু। বাঁশপাতা ঝড়ে যায়, বাঁশবনে মর্মর ডাইনিরা কাঁদে। আমার পিছনে সে, তার পিছনে আমি, ঘুরেমরি ক্রমাগত ভুতের সন্ধানে।
শিল্পী – সিদ্ধার্থ পাত্র