শাশ্বত বসুর গল্প

প্রতীকী ছবি

পুতুল বাড়ি

বাড়িটা বেশ পুরোনো| কতকাল ধরে একলা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, ঘুন ধরা কঙ্কালের গোড়ায় গিয়ে ঠেকেছে, তার ইয়ত্তা নেই| বাড়িটার সব থেকে বড় সমস্যা ঠিক কি? বাড়িটা পুরোনো? নাকি বাড়িটা ভীষণ একলা? কোনটা? প্রায় প্রাগৈতিহাসিক কালের থেকে নরম রোদ, বাড়িটার গায়ে এসে পরে পোঁড়া ইঁটের রং লাল করে দেয়| যেন ইরানী শরাব, ঊর্ণ জালে কস্তুরী হয়ে যাওয়া কোন এক কুলীন সময়ে, বেলোয়ারী কাঁচের গ্লাসে টল টল করতে করতে কত মেহফিল রঙ্গীন করে গেছে, এ বাড়ির প্রতিটা ইঁট কে স্বাক্ষী করে| এখন আর এ বাড়িটায় বিশেষ কেউ থাকে না| শুধু এক তলায় এক দু ঘর ভাড়াটে| সদর দরজার উপর বাইরের দিক থেকে, দুপাশ দিয়ে বেশ অদ্ভুত দেখতে, দুটো পুতুল ঝুলছে| ঠিক কবে থেকে ঝুলছে, এর আগে ওরা ঠিক কোথায় ছিল, কেউ জানে না| দু হাত জড়ো করে ওরা আসা যাওয়ার পথে, সবাইকে নমস্কার জানায়| ওদের দেখেই হয়তো ভাঙা দরজাটার দিকে চোখ যায় পথ চলতি মানুষের| দরজাটাও ওদের সাথে আধখাওয়া পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে ঝুলতে থাকে, শুধু দুটো কব্জায় শরীর এলিয়ে দিয়ে| হয়তো ওই দুটো পুতুলের জন্যই কেউ কোনোদিন বাড়িটার নাম রেখেছিল, ‘পুতুল বাড়ি’| বাড়িটার উত্তরের কান ঘেঁষে চলে গিয়েছে, শিয়ালদাহ-মাঝেরহাট রেললাইন| সামনের রাস্তা পেরোলেই গঙ্গা| জল আর বাড়িটার মাঝে ক্রোধ-ঘৃণা-রক্ত-মাংসের তফাৎ এঁকে দিয়েছে এই সাপের মতো রেল লাইনটাই| ঝমাঝম ঝাঁপিয়ে যখন ফুল স্পীডে আপ কিংবা ডাউনের দিকে ট্রেন চলে যায়, নাগরিক ব্যস্ততাকে ঘুমের ঘন্টি ছুঁড়ে দিয়ে, তালে তালে বাড়িটাও দুলে ওঠে| আর সেই দুলুনি এসে চুঁইয়ে পরে, বাড়িটার ঠিক মাথায় বাঁধা পরীটার গা বেয়ে| ওই পরীটার গা বেয়েই সন্ধ্যে নামে শোভাবাজারের মোড়ে| অনিত্য গলি ঘুঁচিতে আবির্ভাব হয় ময়না, চাঁদনী অনন্যাদের| সুতোর মত কুন্ডলী পাঁকিয়ে পিচ রাস্তা টা, ওদের শরীর বেয়ে চলে আসতে চায় বাড়িটার কোলে| এমনই কোন এক সন্ধ্যেবেলায় বাড়িটার সামনের ঝুলতে থাকা আটপৌরে বারান্দাটায় এসে দাঁড়ায় দুলালী, হাতে তেলের প্রদীপ নিয়ে| তার হাতের ধূপের গন্ধটা গড়িয়ে এসে একতলার ভিক্টরিয়ান কার্নিশে জমা হয়|পোষা বেড়ালটা রাতের মাছ-ভাতের লোভে, এখন থেকেই জমা হয়েছে সেখানটায়| দুলালীর মাথার চুলগুলো সাদা পাটের গাদার মত দুদিকে ফাঁক করা, মাঝের সরু সিঁথিতে উঁকি দিচ্ছে রক্তের মত টকটকে এক চিলতে সিঁদুর| বারান্দা থেকে গলির মুখটা অবধি দেখা যায়| সেখানে তখন লাল বাতির ইস্তাহার| ঠিক যেমন মজলিশ অনেক আগে বসত এ বাড়িটায়| ব্রিটিশ সাহেব আর বানিয়াদের ফুর্তি করার সময় লাল রঙের বাড়িটা কেঁপে উঠত টপ্পা-ঠুমরী-দাদরা সাথে ভারী নুপুরের চড়া কম্পাঙ্কে| তারপর সারারাত এ বাড়ির কোন এক চোর কুঠুরীতে কুমারীর সর্বনাশের শুরু,যৌনপিপাসু হায়নার উল্লাস, নারীকন্ঠের গগনভেদী আর্তনাদ, ভোরের দিকে একটি করে বিবস্ত্র প্রতিমার মুখ ভেসে উঠত চাঁপাতলার ঘাটের পাশের নরম মাটিতে| অনেক পরে এই বাড়িটা বাঈজী বাড়ী হয়ে যায়| সকাল-দুপর-বিকেল খদ্দেরের আনাগোনা লেগে থাকত বাড়িটায়| আজ বাড়িটা একেবারে একা| এমনই কোন এক পতিতা গর্ভে জন্ম হয়েছিল এই বুড়ি দুলালীর| কৈশোর যৌবনের অনেকগুলো আত্মঘাতী সন্ধ্যে পেরিয়ে, দুলালী রানীর জীবনে এখন ‘বুড়াপা’ এসেছে| এই পুরো বাড়িটার দোতলা জুড়ে একা একা হেঁটে বেড়ায় সে, খুঁজে বেড়ায় তার অন্ধ অতীত| গঙ্গার ঘাটের দিক থেকে বয়ে আসা হাওয়াটার অনিবার্য্য ধূলিকণা, তাকে মনে করায় তার হারানো ‘জওয়ানি’| ঠিক তখনই বি কে পালের দিক থেকে একটা গন্ধ ভেসে আসে বাড়িটার দিকে| খোলায় ভাজা চীনাবাদাম আর গণিকার স্বেদ মিলে মিশে থাকে গন্ধটায়| দূরের চাঁপাতলার ঘাট থেকে একটা আলো, শোভাবাজার স্টেশনের দিকে যায়, প্লাটফর্মের বাতিগুলোর সাথে ফিসফিস করে কথা বলে| আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে নিভে যেতে হবে ওদের| নাহলে মধ্যরাতের চাঁদের নীল জ্যোৎস্না, কি করে খোলা ছাতের পাঁচিল টপকে ঢুকে সারা রাত পুরো ছাত ময় গোল্লাছুট খেলবে? আজ এই জ্যোৎস্নার পথ ধরেই কেউ আসবে, তাকে যে আসতেই হবে| তার আসার জন্য সকাম বাসনায় রাত জাগবে পুরো বাড়িটা| এ যে যুগের নিয়ম, সেই নিয়মের অন্যথা হবার উপায় নেই| সেই নিয়ম মেনেই তো এতকাল ধরে সব টিকে আছে| এই টিকে থাকার একটা মুখবন্ধ নিয়ম আছে| গঙ্গার দিকের হাওয়াটা আবার বইতে শুরু করে| একটা হালকা শিরশিরে ভালো লাগা আছে হাওয়াটায়| যত রাত বাড়ে, ভালো লাগাটা আরো গাঢ় হয় দুলালীর| ঘরের পেন্ডুলাম ক্লক টায় রাত আটটার ঘন্টা পরে|

শোভাবাজার মোর থেকে বড় গাড়িটা, এক নিঃশ্বাসে এসে থামে গলির মুখটায়| এরপরে এদিকটায় আর গাড়ি ঢুকবেনা| গাড়িটা থেকে নেমে পরে এক সুবেশী অ্যাংলো যুবক| সাথে ববি প্রিন্টের টপ আর জিন্স পরিহিতা এক তন্বী| চোখদুটো টানা টানা, নিজের একঢাল চুলে হাত বুলিয়ে সে, হাত ধরে অ্যাংলো যুবকটিকে নিয়ে, বাড়িটার ভেতর ঢোকে| সদর দরজাটা তার মাখনের মত তালুর চাপেই খুলে যায়| ভিতরে ঢুকে সশব্দে সেটাকে বন্ধও করে দেয় মেয়েটি| ভিতরটায় কালো মুখোশের অন্ধকার, ঘিরে আছে চারিদিক| পুরোনো কালের কাঠের সিঁড়িটা বেয়ে খট খট শব্দ করে, উপরের তলায় উঠে যায় ওরা| পুরো তলাটাই সন্ধ্যের সদ্যঃপাতী অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে আছে| অ্যাংলো যুবকটি মেয়েটিকে অনুসরণ করছে শুধু, মন্ত্রমুগধ দাসের মত| বাবুকে মেয়েটি পাকড়েছে বড় রাস্তা থেকে| তার শরীরের জেল্লা দেখে যে কেউই তার কুহকে আটক পড়তে বাধ্য| তবু এই বাবুটিকেই সে বেছে নিয়েছে আজকে রাতের জন্য| এই মুহূর্তে ছেলেটির মন ও মস্তিষ্ক জুড়ে আসন্ন রতিকালে, একটি উজ্জ্বল পেলব শরীর সম্ভোগের প্রসন্নতা কাজ করছে, নাকি এই মায়াপুরীর দায়বদ্ধ মন্ত্রযাপনকে নিজের নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে সে, সেটা বলা মুশকিল| ক্রমশঃ তারা ঢুকে আসে দোতলার একটি ঘরে| অদ্ভুত ভাবে এই ঘরের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ নয়| এই ঘর মেয়েটির বহু পরিচিত| দীর্ঘ্যকালের একান্নবর্তী সম্পর্ক তার এই বাড়িটার সাথে| বোঝাই যায় ঘরটি প্রায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের| পুরোনো পালঙ্ক, বিশাল কারুকাজ করা কাঠের দেরাজ, দেওয়ালে বিশাল বিলিতি চিত্রকরের আঁকা ছবি, সব কিছু ছাপিয়ে চোখ চলে যায় দেওয়াল থেকে ঝুলতে থাকা, ভিক্টরিয়ান যুগের সাজের আয়নাটার দিকে| বাহারি ফ্রেমে বাঁধানো সেটা| সামনের টেবিলে রাখা জিনিসগুলো কোনো রমণীর নিত্য ব্যবহৃত, দেখলেই বোঝা যায়| একটা হাতির দাঁতের চিরুনী, কিছু কাঠের বাক্স, গায়ে সুচারু শিল্পকর্ম এবং একটি রুপোর সিঁদুর কৌটো, ঢাকনাটা পাশে পরে আছে পরশ্রীকাতর নির্লজ্জ মেয়েলীপনায়| সেই রমনীই হয়তো সন্ধ্যায় বড় করে কপালে টিপ দিয়েছে সিঁদুরের, দিতে গিয়ে ছড়িয়েছে টেবিলটা জুড়ে কিংবা হয়তো সেটা নিয়ে কোনো সভ্য খেলা খেলেছে| ছেলেটাকে এবার চিৎ করে বিছানায় ফেলে তার ওপর চড়ে বসে মেয়েটি| ক্রমশঃ নিজের উর্ধাঙ্গ উন্মুক্ত করে, মেদোক্ত মাদকতায় খুলে ফেলে নিজের ব্রেসিয়ার| পাকা পেঁপের মত সুডৌল আপিন দোল দোল দুলুনি হতে থাকে| এরই মধ্যে অ্যাংলো সাহেবের উদ্যাপিত শিশ্ন, নিজের ময়াল যোনিগহ্বরে প্রবেশ করিয়েছে সে| ক্রমে দোলের মাত্রা বাড়তে থাকে, ছেলেটির চোখ বুজে আসে মনোক্রমী যৌনসুখে| হঠাৎ স্খলনের ঠিক আগে সে অনুভব করে, তার ঘাড়ের কাছে এক তীব্র শকুন দংশন| চোখ মেলে সে দেখে মেয়েটি নিজের তীক্ষ্ণ শ্বাদন্ত দিয়ে তার টুটি কামড়ে ধরেছে| কালো প্লাজমার মত ঘনীভূত রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক| কোনভাবে ছেলেটি তাকে ছাড়াতে চেষ্টা করে| মেয়েটির হাতে তখন জেগে উঠেছে ক্ষুধাতুর হীংস্র নখ| এতক্ষন যে নখে ছিল কামদেবীর প্রলোভন, এখন তা তাজা রক্তের স্বাদে পৈশাচিক কাব্যে পর্য্যবসিত হয়েছে| দেখতে দেখতে মেয়েটি তার হাতের নখগুলো দিয়ে, ছেলেটির বুক চিরে দেয়| নিদাঘী চাবুকের মত ফিনকি দিয়ে রক্তের ধারা, ঘরটার নিভু কর্পূর গন্ধকে ফুঁড়ে, ফেনা তুলে, ছড়িয়ে পরে চারপাশে| মেয়েটি তার লোলজিহ্বা দিয়ে চেটে, আকণ্ঠ পান করতে থাকে, সেই সাদা চামড়ার তাজা লাশের রক্ত| ছেলেটির হৃৎপিণ্ডে তখনও লাব-ডুব আওয়াজটা চলছে| তার বক্ষদেশের চামড়ার নীচে থেকে, কাঁচা মাংস খুবলে খেতে থাকে মেয়েটি| একটা তীব্র চিৎকার, তারপরে অপার নিস্তব্ধতা, ঠিক যেমনটা আজ সন্ধ্যেয় ছিল| মেয়েটি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে, আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়ায়| আয়নাটার সারা গা বেয়ে তখন, চুঁয়ে পড়ছে পুরু রক্তের ধারা| মৃত্যুর ছায়া তখন বাড়িময় ছড়িয়ে গিয়েছে| মেয়েটির শরীর ক্রমশঃ পরিবর্তিত হতে থাকে| তার উন্নত বক্ষযুগল শুকিয়ে আসে ক্রমশঃ, স্তনবৃন্ত অপরিণত হয়, সুনিপুণ কটিদেশে মেদ এসে জমা হয়, চামড়া কুঁচকোতে থাকে, পরিপুষ্ট নিতম্ব যুগল ইস্ট্রোজেনের অভাবে কাষ্ঠল হয়ে আসে| মেয়েটি আস্তে আস্তে দুলালী হতে থাকে| এই মেটামরফোসিস শেষ হলে, আয়নার গা থেকে রক্ত আঙুলে মেখে, কপালে টিপ দেয় দুলালী| বাগানের দক্ষিণের কামিনী গাছটায়, ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল এসেছে| এতক্ষন ওদিকে হাওয়া বন্ধ ছিল, দমকা হাওয়ায় কুন্ডলী পাকিয়ে একটা তুরীয় গন্ধ ভেসে আসে সেদিক থেকে, চাপা দিয়ে দেয় কাঁচা মাংসের তীব্র গন্ধটাকে| আজ ভোররাতে আবার চাঁপাতলা ঘাটের দক্ষিণে, ভেসে উঠবে এক অ্যাংলো সাহেবের লাশ| এভাবেই দুলালী বেঁচে থাকবে, কালনিদ্রার ঈশ্বরী অতৃপ্তি নিয়ে| পুতুল বাড়ির বাতাসে বারবার বাজবে, মৃত্যুর ঠিক আগের সঞ্চারী বিষন্নতা| ঠিক যেমন পরীটার গা বেয়ে, পূর্ণিমার চাঁদ টা গোলাপি জামা গায়ে দিয়ে, নেমে আসে অলৌকিক হিম জ্যোৎস্নার হাত ধরে|

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By শাশ্বত বোস

জন্ম ১৯৮৯ সালের জানুয়ারী মাসে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুর শহরে । হুগলী জেলারই রিষড়া শহরে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ২০০৫ ও ২০০৭ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন । ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখালেখির সাথে যুক্ত। বিভিন্ন নামী পত্রিকা যেমন সন্দেশ, জোয়ার, কোরক, পথ ও পাঁচালি ইত্যাদি পরিবারের তিনি নিয়মিত সদস্য ছিলেন ।

Leave a Reply