জলছবি
অজস্র স্রোত বয়ে যায়, বয়ে যায় জোয়ারের খেলা
ভাটার টানে খানিক ফিরেও আসে কালো জল,
ক্ষত বাড়ায় একেকটি কৃষ্ণগহ্বরের
মায়াময় জোছনা, ভোজবাজির হাট
শুধু যাওয়া আসার ঘাটে
ফেলে আসা মুহূর্তরা গমক তোলে
মূর্ছনায় খুঁজে ফিরি সেই শুদ্ধ স্বর।
অন্ধকার এলে হাতের তালু
তোমার নামে জমায় খানিক অভিমান
দেখা যায় না কিছুই
না অভিমান না তোমাকে
তবুও রোদবেলায় পেরোতে হয়
জেব্রা, ফুটপাত, রেল ক্রসিং
জারবেরা, ফুসিয়া আর গোলাপের ধারে।
পথ হবে না শেষ হেঁটে যাওয়া শেষেও
অন্ধকারে সিঁথিচেরা আরও গাঢ় মেঘ মেখে মেখে
তখনই জলছবি ফুটে ওঠে রাতের আদলে
কবেকার সেই মেয়েবেলা
গান গায়, গায় গান, কিঙ্করী হরে প্রিয় সাজে
শহর দেখছে
এ শহর রোজ কফিন দেখেছে কত
এ শহর রোজ জন্ম দেখেছে অধিক
ছেঁড়া চিরকূটে জন্ম পাঁচালী লেখা
আধপোড়া চাঁদ খেয়েছে রুটির মতো।
ক্লান্ত পথের শান্তি জানা তো নেই
রিকশা টেনে এখনও ছুটছে পায়ে
চায়ের দোকানে আঁচ দিয়েছে সবে
ভোর থেকে রাত আগুন তো আছে পেটেই।
একের বদলে শূন্য লিখেছে কেরানি
চাকরি যাবে কি ধোলাই হবে জানি না
আকাশছোঁয়া দামেই হয়েছে ভুল
দুটো পয়সার হাত ফেরি আমদানি।
এ শহর কত প্রেম খোঁজে প্রেম-ভাঙায়
জাহাজ ভর্তি স্বপ্নের ভরাডুবি
জোচ্চুরি আর বাটপাড়ি রাত দিন
বেতসলতার ফুল ফোটে আজ ডাঙায়।
স্মৃতিঘর
দীর্ঘ পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত ?
এখনও কতখানি পথ বাকি আছে
হেঁটে দৌড়ে লাফিয়ে যাবার।
সব মুহূর্তগুলোই তো হুশ করে বড় হয়ে যায়
হয়ে যায় এক একটি দীঘিসম স্মৃতির আধার
মুহূর্তে পিছু ফিরে দেখলে আর পিতা পুত্রের বয়সের হিসাব মেলাতে পারি না,
পাই না মায়ের আঁচলের হলুদ বাটা হাত মোছার গন্ধ।
এমন করেই প্রাচীন কথা আর সুর ভুলে গিয়ে
আমরা তৈরী করি একেকটি স্মৃতিঘর
চোয়ালে হাত আর শূন্য চোখে ভাবি
শৈশব কত না ছিল নির্মল !
গন্তব্যহীন
চলো আজ হাতে হাতে হাঁটি
আলোর কাছে গোপন কিছু তো নয়
সব উঠোনে মেলা জামাকাপড়ের মতো
নিংড়ে মেলে দিই শুকনো হবে বলে।
চলো রাস্তায় থমকানো জল পেরিয়ে
কোলাহল বিমুখে হাঁটি
–গন্তব্য ?
নির্দিষ্ট কিছু তো নেই
আসলে হারিয়ে যাবো বলে ঠিক করিনি কিছুই
সবকিছুর উৎসস্থল যেমন খুঁজতে পারি না
খুঁজতে নেই উপসংহারও
শুধু বয়ে চলাতেই আনন্দ
তরঙ্গ
ভ্যান গঘ হতে পারিনি
স্কাল্পচার আঁকতে পারিনি,
বুঝিনি শুভা মুদগল-এর আলাপ
তবুও তান ধরি দু’চারটা।
চিরকাল ছিলিম ছিলিম সন্ধ্যায়
যখন আজানের সুর আর কীর্তন মেশে
আমার কান উন্মুক্ত হয় আনন্দে,
সেই ক্ষণে সরলমতি কমলবনে
তুমি জলের মতো তরল হও
নিস্তরঙ্গ বুকে সমুদ্র গর্জন ওঠে।
দু’একটা মাছরাঙা বাঁশের ঝাড়ে বসে
টিয়া পেয়ারা ফুলের গন্ধ নেয়
সবুজ ঘাসে একপাটি দাঁত বসায় গাভী
গোধূলির কাছে ঋণ বাড়ে শুকনো ধুলোর
বলো পৃথিবী, শরীর শান্ত হবে কিসে ?
এ তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কত আলপথ হেঁটে যাবে ?
সরলরেখায় গান্ধর্বের হেঁয়ালি রেখো না হে !
ছবি – নন্দলাল বসু