পাশের বাড়ি গোপাল মাহাতোর ঘর।  আমাদের গোপাল জ্যাঠা।  গোপাল জ্যাঠার দুই ছেলে ইন্দ্রজিৎ আর বিশ্বজিৎ।  ইন্দ্রজিৎ আমার নীচের ক্লাসে পড়ত। মাটির সাথে মিশে ছিল ওদের ঘর।  ভাঙা টালির ঘর।  টালির ফাঁকে জল ঢুকতো রোদ ঢুকতো ,  এভাবেই ওরা শ্বাস নিতে নিতে বেঁচে ছিল।  মস্ত একটা উঠোন ইন্দ্রদের।  কোনো সদর দরজা ছিল না ওদের ঘরে।  পথিকের দৃষ্টিতে আত্মসমর্পণ করতো ঘর ,  ওদের দুঃখ।

ইন্দ্রজিৎ আমার ছেঁড়া ফাটা বই গুলো নিয়ে স্কুলে যেত।  আমাদের মালথোড় হাই স্কুলে প্রার্থনা লাইনে স্বামীজির বাণী পাঠ করানো হতো।  ইন্দ্রজিতের মা শিক্ষা বোঝে না।  ছেলেকে স্কুলে পাঠায় লড়াই করে।  ইন্দ্রজিৎ না খেয়ে স্কুলে যায় আর প্রার্থনা লাইনে সমস্বরে বলে–

” আমি ভারতবাসী
ভারতবাসী আমার ভাই
ভারতবাসী আমার প্রাণ …
ভারতের মৃত্তিকা আমার মা … ”

অকপটে মিথ্যে কথা বলে ইন্দ্রজিৎ।  ভারতবর্ষ ওর ক্ষুধার পাশে ছিল না।

আমি ছোটোবেলায় ইন্দ্রদের উঠোনেই খেলতে যেতা।   দেখতাম গোপাল জ্যাঠা কাশে খুব।  কাশতে কাশতে রক্ত বের হয় মুখ দিয়ে।  এই রক্ত রাঙিয়ে দিয়েছে আমার শৈশব।

ওরা মাড় ভাত খেত দুবেলা ,  সাথে অল্প তেল দিয়ে শাক ভাজা।  আমরা মধ্যবিত্ত।  আমাদের বাড়িতে ভাত ডাল একটা তরকারি হতো দুপুরে। গোপাল জ্যাঠা জারমনির বাটি নিয়ে তরকারি নিতে আসতো আমাদের উঠোনে , ঘরোয়া সম্পর্কে যেমন টা হয় আর কি ।

তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি ।  গোপাল জ্যাঠা মুখ থুবড়ে পড়ল পাথরে ।  চাপ চাপ রক্ত বের হয়ে এলো গোপাল জ্যাঠার মুখ দিয়ে।  রক্তে ভিজে গেল আমার কৈশোর । আগলে ছিলাম কিছুক্ষণ । তারপর ঘটি নিয়ে এল জেঠই । জল হল জীবন ।

যক্ষ্মায় প্রাণ গেল গোপাল মাহাতোর ।  ক্ষুধায় প্রাণ গেল গোপাল মাহাতোর ।  এখনো মাঝে মাঝে স্বপ্নে গোপাল জ্যাঠা জারমনির বাটি হাতে আমাদের উঠোনে এসে দাঁড়ায় ।  আমি আত্মাকে ক্ষুধার পুণর্জন্ম ভেবে ভয় পেয়ে সরে আসি

ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply