ভ্রমণ মানসিকতাঃ সেকাল ও একাল

মা-বাবার সঙ্গে আমার প্রথম বেড়াতে যাওয়া ছয় বছর বয়সে। সঙ্গে ছিলেন আমার মাসি। তখন বইমেলা থেকে একটি আবশ্যিক কেনার জিনিস ছিল “ভ্রমণসঙ্গী”। বেশ কয়েকদিন আগে থেকে ভ্রমণসঙ্গী ঘেঁটে, পুরীর পান্থনিবাসে থাকা হবে ঠিক করা হয়েছিল। ধৌলি এক্সপ্রেসে গিয়েছিলাম আমরা। আমার মাসি আবার ‘সানন্দা’র একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। সেখান থেকে জানতে পেরেছিলেন পুরীর অদূরে “তোষালি স্যান্ডস” নামে একটি দূর্দান্ত রিসর্ট আছে। সেটি ওঁকে দেখতে হবে। তখন তো জিপিএস ছিল না। স্থানীয় লোকজনই তখন পথপ্রদর্শকের কাজ করত। মনে আছে আমরা পান্থনিবাস থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে খুঁজে খুঁজে তোষালি স্যান্ডস গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথমবার এমন একটি বিলাসবহুল রিসর্ট দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলাম। বরাবরই আমাদের বেড়াতে গিয়ে বিলাসিতার পরিবর্তে প্রকৃতি আস্বাদনেই নজর থাকত বেশি। মা-বাবাই এই পাঠ দিয়েছিলেন। তাই জীবনে প্রথম বিলাসবহুল রিসর্ট দেখে ঘোর কাটছিল না যেন! সুইমিং পুল, কাঁচে ঘেরা ডাইনিং হল- কেমন যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল।
এরপর আর একটু বড় হয়ে আমরা দার্জিলিং, গ্যাংটক ও জলদাপাড়া গিয়েছিলাম। গ্যাংটকে সিনিওলচু লজ বলে একটি জায়গায় আমরা ছিলাম। এখন সেটি একটি বিলাসবহুল রিসর্ট হয়ে গেছে। মনে আছে আমাদের ঘরের পর্দা সরিয়ে মা সকালবেলা এক দুর্দান্ত সূর্যোদয় দেখিয়েছিলেন, কাঞ্চনজঞঘাকে সাক্ষী রেখে। এখনও সে দৃশ্য মনে গেঁথে রয়েছে। ছোটবেলায় এই দার্জিলিং ভ্রমণ থেকেই আমার পাহাড়প্রেমের সূত্রপাত।
“কী আশ্চর্য, হঠাৎ মেঘের মাঝখান দিয়ে দেখা দিল নীলাকাশ। দু-পাশে ঘনকৃষ্ণ মেঘ, মাঝখানে একটা মেঘলোকের উপত্যকা, ঠিক যেন ঘনকৃষ্ণ চুলের মাঝে সিঁথির মতো ফুটে উঠল আকাশ। কোন অদৃশ্য হাত সেই সীমন্তিনীর সিঁথির উপর দিয়ে দিল সিঁদুরের প্রলেপ।.. গর্বোন্নত কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষচূড়ায় লেগেছে আবিরের আস্তরণ। মেঘের মাথায় মাথায় সোনালি জারোয়া ও চুমকির কাজ করা। এক টুকরা ছুট-মেঘ কী করে দলছাড়া হয়ে গিয়ে পড়ল উদীয়মান দিনকরের রংমহলে।বেচারির পরনে ছিল সাদা সিল্কের শাড়ি ধোপ ভাঙা। ও বোধহয় জানত না হোলি খেলায় মাতোয়ারা হয়েছেন উদয়ভাস্কর। বালার্ক সূর্য বালসুলভ চপলতায় ফাগুয়ার প্রলেপে আরক্তিম করে দিলেন মেঘখণ্ডকে। বেচারি লজ্জায় লাল হয়ে মিশে গেল বড়ো মেঘের দলে।.. উত্তরদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, জন্নু, কাব্রু প্রভৃতি পর্বতশৃঙ্গে আলপনা আঁকা ততক্ষণে সারা। উত্তর-পশ্চিম কোণে ফুটে উঠেছে এভারেস্ট, থ্রি সিস্টারস। যুক্ত করে প্রণাম জানালাম গৌরীশৃঙ্গকে।”(মেঘলোকের দেশে, নারায়ণ সান্যাল)। দার্জিলিং বেরাতে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল এই ভাষায় তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেন, যেন আমারই মনের কথা।
মা-বাবার সঙ্গে তাদের ও আমার স্কুলে ছুটি অনুযায়ী আমরা প্রতি বছর কোথাও না কোথাও যেতাম। তাদের দেখতাম কোথাও যাওয়ার আগে সবসমইয়ে ‘ভ্রমণসঙ্গী’ একবার ঘেঁটে নিতেন। কয়েক বছরের পুরনো হলেও সেই বই-ই একবার দেখে নেওয়া রেওয়াজ ছিল।
কালের নিয়মে আমাদের বেড়ানোর ধাঁচে এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে এসেছে বিপুল পরিবর্তন। ভ্রমণসঙ্গীর জায়গা নিয়েছে নানান ট্র্যাভেল ব্লগ। এখন আমাদের ঘরে ‘আদ্যিকালের ভ্রমণসঙ্গী’ থাকলেও আমরা পছন্দ করি ‘হাতে গরম ফিডব্যাক’ নিতে। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার দরুণ বেশিরভাগ লোকজন নিজের অভিজ্ঞতা কোনও ট্র্যাভেল গ্রুপ বা ফেসবুক পেজে শেয়ার করেন। এর ফলে বৃহত্তর জনগণ নাগাল পেয়ে যান টাটকা সব অভিজ্ঞতার। কোথায় কোথায় যাবেন, কি কি খাবেন এবং কোথায় থাকবেন তার যেমন বিস্তারিত বিবরণ থাকে, সঙ্গে থাকে ড্রাইভারের নম্বরও। এর ফলে আমরা প্রায় লাইভ অভিজ্ঞতা ও ছবি দেখতে পেলেও আমাদের সেই চিরকালীন বই ঘাঁটার অভ্যাস আজ লুপ্তপ্রায়।
আরও একটি বিষয় ঐসময়ে বেড়াতে বেরনোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। তা হল ভোরবেলা হাওড়া স্টেশন বা শিয়ালদা যাওয়ার জন্য আগে থেকে পাড়ার হলুদ ট্যাক্সি খুঁজে সেই গাড়ির চালককে বলে রাখা হত নির্দিষ্ট সময়ে আসার জন্য। তখন ওলা-উবের “ স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা” সাতসাগরের পারে যার বাস।
আমাদের শহরতলির পাড়ায় এইরকম এক ট্যাক্সিকাকু ছিলেন। ঝাড়্গ্রাম বেড়াতে যাওয়ার সময়ে হাওড়া স্টেশনে নিয়ে গিয়ে খুব ভোরের ট্রেন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ অবশ্য এই করোনা পূর্ববর্তীকালে আন্দামানের ফ্লাইট ধরার সময়ে “প্রি-শিডিউল্ড” উবের বাড়ির দরজায় এসে ফোন করে। এখন আমাদের পরের প্রজন্ম আর বাবা’র হাত ধরে ট্যাক্সিকাকুকে খুঁজতে বেরোয় না। “ভ্রমণসঙ্গী” বাদ দিয়ে যেমন তারা “vlog (video blog=vlog)” দেখে, তেমনই মোবাইলের এক ক্লিকে গন্তব্যের গাড়ি বাড়ির সামনে নিয়ে আসে।
তবে ছোটবেলার একটি বেড়ানোর উপকরণ কালের ফেরেও একই রয়ে গেছে। তা হল হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ি। মা কলেজে পড়াতেন। মা’র দুই সহকর্মী সমীরজেঠু ও পার্থকাকু তাঁদের পরিবারসহ আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যেতেন। মা’কে আগের দিন রাতে ফোনে বলতে শুনেছি “সমীরদা, কাল তাহলে সবাই দেখা করছি অমুক সময়ে বড় ঘড়ির নীচে।“ এর কয়েক যুগ পর আমরা কয়েকজন কলিগ মিলে উত্তরবঙ্গ যাওয়ার সময়ে আমি আগের দিন ফোন করে তাদের জানালাম “কাল দেখা হচ্ছে বড় ঘড়ির নীচে।“ সময় বদলালেও বড় ঘড়ির নীচে সময়ের কাঁটা থমকে যায়।
এখন ট্রেন বা দূরপাল্লার বাসে অনেক সময়ে দেখি লোকজন কিছুক্ষণ পরেই কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে শুয়ে পড়ে বা ঘুমিয়েই পড়ে। পাশের লোকজনের সঙ্গে গল্প করার মানসিকতা কারও নেই। মনে আছে ধৌলি এক্সপ্রেসে করে পুরী যাওয়ার সময়ে একই কামরায় আমার তিনজন বন্ধু হয়েছিল। হাসি-ঠাট্টা-গল্পে সারা রাস্তা মাতিয়ে রেখেছিলাম আমরা। এখন সবাই কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক, আমি-সর্বস্ব হয়ে গেছে। যুগের হাওয়া করে তুলেছে সবাইকে কম-বেশি স্বার্থপর এবং বোকা-বাক্সমুখী। এখনকার এসি থ্রি-টায়ারে বদ্ধভাবে হিমশীতল বাক্সতে বেড়াতে যাওয়ার থেকে ছোটবেলার সেই স্লিপার ক্লাসের দিনগুলি খুব রোমাঞ্চকর ছিল। ট্রেনের সেই যে অদ্ভূত ‘ঝিকঝিক’ আওয়াজ, যা বেড়ানোর আমেজ এনে দেয় তা এসি কামরায় পাওয়া দুষ্কর— এ যেন এক নির্বান্ধব,নিঝুমপুরী…
বাবা-মা এর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার সময়ে আর এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল কোডাক ক্রোমা ক্যামেরা। একটি রিলে ৩৬টি ছবি তোলা যেত৷ মিতব্যয়ী বাবার কড়া নির্দেশ ছিল ‘অকারণ’ ছবি না তুলে যেন প্রয়োজনীয় ক’টিই তোলা হয়৷ তখন একটি রিল ও ছিল অমূল্য। মোবাইলের স্টোরেজ ভরিয়ে বিভিন্নভাবে ‘পাউট’ করে সেল্ফি বা ডিএসএলআর এর সদর্প উপস্থিতি তখন আমাদের গ্রাস করে নি। সাতদিনের ‘টুর আইটারিনারি’তে তোলা ৩৬ টি ছবি নেগেটিভ থেকে ছাপিয়ে আমাদের আনন্দ থাকত দেখার মতো….অনেকদিন পর পর সেই সব album দেখতাম। এখন অবশ্য আমার পুত্র নিজের অন্নপ্রাশনের album ছাড়া আর কোনও album তেমন দেখে নি। তাও আমি কিছু কিছু ছবি প্রিন্ট করে ঘর সাজাবার চেষ্টা করি।
ছোটবেলার দিনগুলো মনে পড়লে বার বারই একটা কথা মনে হয়। আজ অনেক মানুষ বেড়াতে যায় খানিকটা হলেও ‘দেখনদারি’ র জন্য। প্রকৃতির রসাস্বাদনের থেকেও এখন গুরুত্বপূর্ণ ‘ travelling to’ স্টেটাস দেওয়া। এইরকম মনোভাব বর্তমানে আমাদের বেড়াতে যাওয়াকেও কেমন যেন কৃত্রিম করে তুলছে। আমরা যদি বাংলা বা ইংরেজিতে ভ্রমণসাহিত্যের বইগুলি পড়ি যেমন উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘মণিমহেশ’ বা নবনীতা দেবসেনের ভ্রমণ সমগ্র, সেখানে আছে মায়ামাখা চোখে পৃথিবীকে দেখা। প্রকৃতির রসে জারিত হয়ে ওঠা। সেকালের বইগুলিতে তেমন কোনও ছবি নেই কিন্তু। তাও ঠায় বসে পড়তে হয়। একটি কথা অনস্বীকার্য। এখনকার প্রযুক্তি নির্ভরতার যুগে আমরা যতই video blog নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি আর ইউটিউবে ভিউ বাড়াই না কেন ভ্রমণের বই পড়ে বা ভ্রমণসঙ্গী ঘেঁটে যে জ্ঞান আহরণ ও মানস-ভ্রমণ হত তার প্রভাব অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী।
নবনীতা দেবসেনের কথাতেই এই আলোচনার ইতি টানি- যিনি কখনও ছুটেছেন কুম্ভমেলায় আবার কখনও মালবাহী ট্রাকে চড়ে দুঃসাহসিক পাড়ি জমিয়েছেন অরুণাচলে। “জগতে শুধু এলেই তো হল না, সে তো সবাই আসে। আনন্দযজ্ঞের খোঁজটি পাওয়া চাই, সেটা সবাই পায় না।…..আমি বড় চঞ্চল, বড় অস্থির। কখনো এস্পার,আবার কখনো ওস্পার। এই ছিলুম ঘরে, এই বসেছি পারে। আর ভেতরে ভেতরে? না ঘরের না পারের, স্রেফ পারাপারের সওয়ারি।”
আমরাও যদি এরকম “পারাপারের সওয়ারি” হয়ে উঠতে পারি, সকল কৃত্রিমতাকে পিছনে ফেলে, যদি আবার সেই স্লিপার ক্লাসের আওয়াজ-হাঁকডাকের দুলুনির দিনগুলোতে ফিরতে পারি, আপার ক্লাসের চক্রব্যূহকে ভেদ করে….সেইখানেই ঘটবে আমাদের ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি। ‘

ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply