ডাক এসেছে অসীম থেকে…

“আমার সঙ্গে এসো মহানগরের পথে, যে পথ জটিল, দুর্বল মানুষের জীবনধারার মত, যে পথ অন্ধকার মানুষের মনের অরণ্যের মত, আর যে পথ প্রশস্ত, আলোকোজ্জ্বল, মানুষের বুদ্ধি, মানুষের অদম্য উৎসাহের মত।

এ মহানগরের সঙ্গীত রচনা করা উচিত, ভয়াবহ, বিস্ময়কর সঙ্গীত।”

এ উক্তি প্রেমেন্দ্র মিত্রের। আমাদের সকলেরই ভীষণ পরিচিত। এ গল্পটি লেখা হয়েছিল ১৯৩৩ সালে। সময় উল্লেখ করা প্রয়োজনীয়, কারণ ক্রমশ পরিষ্কার করার আপ্রাণ চেষ্টা করব।

প্রথম যে কবিতা এই বইয়ের তা হল’ “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষে”, যদিও এটি একটি ধারাবাহিক গুচ্ছ, এর পরের অংশ থেকে নাম কবিতার গুচ্ছ।
প্রথম কবিতা পাতাটি কবি সাজিয়ে তুলেছেন এই ডাক দিয়ে, যে ডাক কালের অন্তর্ভুক্ত নয়, যেন কালের গভীরতর অন্ধকার অংশ থেকে আলোর ক্ষীণ সম্ভাবনা ও আশার মত ভেসে আসছে এই ডাক। মানুষ মন্ত্রগ্রস্তের মত পিছু নিচ্ছে:

…তারপর একদিন চলে গেল চাঁদে।
ভূতগ্রস্ত এক অভিযাত্রীর মতো
নিশিতে পাওয়া এক নাবিকের মতো
মানুষ হেঁটে চলেছে, দাঁড় বাইছে, উড়ে যাচ্ছে
এদিকে, ওদিকে, সেদিকে…
শুধু নিজের ভেতর নামতে ভয় পাচ্ছে বলে

যে লাইনগুলি এখানে লেখা হল’ না কবি তাতে স্থান নির্দেশ করেছেন এবং শেষে চাঁদের কথা লিখে কবিতার প্রথমাংশেই বসিয়েছেন কবিতার শেষ যতি।
যে অর্ধ অচেতন ডাকের কথা উল্লেখ করেছি আগেই, তাতেই ভেসে যাচ্ছে মানুষ, যুগ যুখ ধরে, সে অবস্থায় অনুভূতি নেই, শুধু হেঁটে চলা আছে। তাই যতি না থাকাটাই অবশ্যম্ভাবী। শেষের আগের অংশে একটু বিরতি প্রয়োজন ছিল, যেমন আমাদের প্রত্যেকের মাঝে মাঝে প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি বা কয়েকটি আঘাত, জেগে উঠতে, ভেসে উঠতে বা ডুবে যেতে। কিন্তু শূন্যস্থান নয়, আঘাত পাওয়া মানুষের কষ্ট বুঝে, জেনে তাঁদের উপার্জনে কবি বসাচ্ছেন ellipsis, মোলায়েম অথচ নিঁখুত।

একই স্বর যেন উঠে এসেছিল ১৯৩৩ এও, কিম্বা গুলজার সাহেবের লেখা সেই “আদত” নামের কবিতার শেষটুকুতে:

पाँव बेहिस हैं चलते जाते हैं
इक सफ़र है जो बहता रहता है
कितने बरसों से कितनी सदियों से
जिए जाते हैं जिए जाते हैं

आदतें भी अजीब होती हैं

এইদুটো লেখার কথা এই প্রসঙ্গে এল যে, শাস্ত্র মতে কবি, যিনি দ্রষ্টা তিনি কতদিন ধরে মানুষের এই “নিশিতে পাওয়া” দেখে এসেছেন, দেখে আসছেন সময় জুড়ে জুড়ে, কখনও তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্র’র গদ্যে কখনও তিনি গুলজারের নজ়মে তো কখনও তিনি অংশুমান করের বইয়ের প্রথম কবিতায়। কবি আসলে একজনই, কালভেদে তিনি ভিন্ন, বক্তব্য তাঁর অটুট।

ওই গুচ্ছেরই পরের একটি কবিতার দিকে যদি আমরা তাকাই, আমরা নিছক, সাধারণ গড়পড়তা মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে জটিল, নিখাদ একাকীত্বে ভরে উঠেছে মানুষ। জাতির গুমর, বুদ্ধির আস্ফালন গত হয়েছে, “মানুষের বারফট্টাই থেমে গেছে।” আমাদের অবচেতনে একটা ছোট্ট ঢেউ তুলে দেয় পরের লাইনগুলো। এবং পরিস্থিতি কেমন ছোটো ছোটো করে এসে পরপর ধাক্কা দিয়ে গেছে, এর ধারাবাহিকতা আমাদের পাঠক মনে বিষণ্ণতা এনে রাখে। ছুঁয়ে দিয়ে যায় ব্যক্তিগত নিভৃতিকে:

মানুষ বুঝতেই পারেনি
কখন
একলা হয়ে গিয়েছে কাঁধ
কখন
নিঃশব্দে
মানুষের পাশ থেকে ভ্যানিস হয়ে গিয়েছে
মানুষ।

শেষ লাইনে “মানুষ” একা এবং পূর্ণযতি। আমাদের করুণদশার সাক্ষ্য। আমাদের লুন্ঠিতদশার এক এবং একমাত্র প্রমাণ।

এরপরে ধীরে ধীরে নিজেদের অন্তরে ঢুকতে ঢুকতে কী নিপুণ বাঁকে এ বই ঢুকে পড়ছে তথাকথিত ‘সমাজে’, একের মাধ্যমে বলে উঠছে দশের কথা।
স্বাধীনতার এত্ত বছর পরেও দু’জন সাধারণ মানুষ, দলমত নির্বিশেষে একটি বিষয়েই সবসময় একমত। তাঁরা যথেষ্ট পাননি, তাঁদের জন্য যথেষ্ট হয়নি। ফলে ক্ষোভ নয়, দেশ নিজের, দেশের মানুষ নিজের, তাই ক্ষোভ কখনওই নয়, বরং জেগে উঠেছে “অভিমান”। এই শব্দের ব্যবহারে পরিস্ফুট হয় কবির রুচি, জেগে ওঠে জলের থেকে ধীরে, এবং তিনি চাপিয়ে না দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে যান, আমাদের কী করণীয় তার, ক্ষোভের নয় বরং “অভিমান”-এর কথা।

“…রাগী মানুষেরা এ দেশ ছেড়ে চলল। কাগজে ছবি। চ্যানেলে চ্যানেলে
খবর। অভিমানের।

রাগী মানুষেরা পাড়া, শহর, দেশ ছেড়ে চলতে থাকল। চলতেই
থাকল। মনে মনে।”

কী দারুণ ব্যবহার শেষদুটো শব্দের। আমরা কিছুই পেরে উঠছি না, করে ফেলতে পারছি কিছুই এখনি, আমাদের সম্বল শুধুই অপেক্ষা আর ভরসা। তাই আমরা ছেড়ে চলেছি সমস্তই। শান্ত সেই বিকেলে একটা বড় ট্রেনে উঠে চলেই যাচ্ছি আমি সব ছেড়ে। কিন্তু “মনে মনে।”

এতদূর এসে মনে হবে বুঝি কবি অংশুমান কর নিজে জানেন, কোনটা ঠিক, কী করা উচিত, তিনি তাই সচেতন করে দিচ্ছেন আমাদের। আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে বুঝি। কিন্তু না তিনিও সন্দিগ্ধ, এই নিম্নলিখিত কবিতায় এসে তিনি এক করে দিচ্ছেন নিজেকে, আমাদের সঙ্গে। আর আমাদের সবাইকে এক করে রেখে আমাদের করুণ অবস্থার ব্যাখ্যা করছেন ছোটো ছোটো পাঁচটি লাইনে।

“বাস্তব আসলে এক নির্বাসন

বড়রা, জেলের কয়েদি, রয়েছে সেখানে।

শিশুটি সহজে বলছে:
একটা ছোট, একটা বড়
দুটো ‘মুন’ বানালাম বিস্কুট ভেঙে…”

বিসর্জনের আগে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এই অপেক্ষায় যে এই অবিরাম চলতে চলতে কবে, কখন, কোন মোড়ে অবশেষে ফিরবে আমাদের সারল্য, আমাদের নিষ্কৃতি। কোন পথে আসবে সে?

Milosz আর Jeffers এর কিছু কথা দিয়ে সাজানো “Obstine Humanity” নামক প্রবন্ধে Louise Glück লিখছেন:

“No one with impunity/ gives himself the eyes of a God,” Milosz says. Clarity is not within human capability. And yet the preference for clarity over solace and the striving toward it is, in Jeffers, both moving and honorable.
… but there are other and dangerous vanities, intolarences: the tribe’s automatic allegiance to itself, for example, “Cordiality and affection” exclude those who do not participate in the social contract.”

এরপর কবি ঢুকে পড়ছেন দৃশ্যান্তরে, যেন যা কিছু খুব ছোট, তাদের সকলের অবস্থান আর অবস্থা স্পষ্ট করে তুলছেন, কবিতায় আপাত সামান্য কিছু দৃশ্য ব্যবহারে। যেমন:

…রোয়াকে একটিই কুকুর

দিগন্তে, বিন্দুর মতো, একটি ছাগশিশু

“পিগমি” বলতে এইসমস্ত আপাত ছোট, আপাত ক্ষুদ্র এই গুরুত্বহীন দৃশ্য বা জীব বা মানুষগুলিকে মনে হলেও আসলে যে তা আমাদেরই মনের ক্ষুদ্রতা তা বুঝিয়ে তুলছেন তিনি পরের পর কবিতায়, আচমকা নয়, ধীরে ধীরে, ভীষণ যত্ন নিয়ে, যেন কাচের মূল্যবান পাত্রটি বুঝি।
এই কবিতাগুচ্ছ উৎসর্গ করছেন ২৭ নম্বর পাতায়, তরুণ কবিকে এবং খুঁতখুঁতে সম্পাদককে, একজন অভিজ্ঞ অপরজন অভিমানী। তিনি আশ্বাস দিচ্ছেন, এ সঙ্গে থাকবে। এ কবিতা ছেড়ে চলে যাবে না। এর দুর্বলতা প্রকট কিন্তু প্রচ্ছন্নে বিশ্বাসভঙ্গ করার মানসিকতা নেই। যে মানসিকতা আছে আমাদের মনের সেই পূর্বালোচিত অন্ধকারতর কোনটিতে।

“কিন্তু সঙ্গে থাকবে

পাশের বাড়ির মেয়েটির মতো
হঠাৎ একদিন
চলে যাবে না দূরদেশে…”

একেবারে শেষ কবিতায় চলে যেতে চাওয়ার লোভ সামলানো খুব মুশকিল! এ বই দাবি করে সময়। ধীরে ধীরে, বেয়ে বেয়ে যেতে হয়। কবির সিদ্ধান্তের খোঁজে দুম করে শেষে পা বাড়ালেই পিছলে পড়ার সমূহ আশঙ্কা। শেষ অবধি পৌঁছলেও দেখা যাবে দুটি ভিন্ন রূপ। একটি প্রকট অপরটি প্রচ্ছন্ন। একটি তুলে আনছে প্রতিশোধের কথা, অপরটি ভালোবাসার, একই কবিতায় একই লাইনেও কখনও কখনও।

“ডিপ্রেশনের রোগ যার, তাকে শোনাই রবীন্দ্রনাথের গান।
একদিন সুস্থ হবে,
একদিন ভাঙাচোরা, দুর্বল, বেদনাহত এসব কবিতা
নেবে প্রতিশোধ …

… এ আশায় সুড়ঙ্গ নির্মাণ করি
দুর্বল মিলের পাশে প্রতিদিন হাত-ভাঙা শব্দ বসাই”

সন্দেহ থাকতে পারে, মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, যে মৌলিকতা তবে কী? প্রতিশোধ না প্রেম? উত্তর মিলবে এখানেই। ব্যক্তিগত মতে, প্রেম, ভালোবাসাই একমাত্র ওষুধ বলে উঠে এসেছে এখানে, বিশেষত এই শেষ কয়েকটি কবিতায়, নিজের না পাওয়াগুলি ঢেলে সাজিয়ে দিচ্ছেন অপরের সামনে, যাতে সে না কষ্টে থাকে। “আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি”। শেষ লাইনে এসে একা “মানুষ” শব্দের সঙ্গে যেন পূর্ণযতি না বসাতে হয়, এই তাঁর কাম্য।
এবার রইল বাকি মৌলিকতার কথা, অনুভূতির কথা। তার সদুত্তরের জন্য ধার করছি Haruki Murakami কে। “On Originality” প্রবন্ধে এ বিষয়েই এক অংশে তিনি লিখছেন:

“It is my belief that a rich, spontaneous joy lies at the root of all creative expression. What is originality, after all, but the ‘shape’ that results from the natural impulse to communicate to others that feeling of freedom, that uncontrained joy?”

প্রশ্ন দিয়ে শেষ করা এ বাক্যবন্ধ আমাদের জন্যই, তাই নয় কি? এ অসীম চলার ফাঁকে যে উঠে আসে সেই মহান কার্যের অংশটুকু শেষ অবধি, তা যে অনস্বীকার্য! এ চলাতে যতি দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের কাজ শুধু পাশাপাশি থাকার। না ছেড়ে যাওয়ার। কবি অংশুমান কর কে আমার প্রণাম। শেষ করা যাক বরং ভারতীয় সাহিত্যের বিখ্যাত এক কবিতা দিয়ে। যা ধরে রাখবে এর নির্যাসটুকু, প্রেক্ষাপট ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন, তবু কবি তো একজনই, কখনও তিনি এইরূপে তো কখনও অন্যরূপে:

यह महान दृश्य है,
चल रहा मनुष्य है,
अश्रु श्वेद रक्त से,
लथपथ लथपथ लथपथ,
अग्निपथ अग्निपथ अग्निपथ।।

(হরিবংশরায় বচ্চন)

বইয়ের নাম: পিগমিরা লিখছে
কবি: অংশুমান কর
প্রকাশক: সিগনেট প্রেস
মূল্য: ১০০ টা

ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply