মোহনচূড়া
কখনও দেখতে পাব না কি
তোমার ভিতর সাজ খুলেছে
মোহনচূড়া পাখি ?
একটু দূরে, পাশের গাছে
আরেক মোহনচূড়ার ডাক,
দেখেও দেখছ না !
এবং রাগ করেছ এতই
অঙ্গ এবং কণ্ঠ থেকে
চলকে রাগের সোনা
পাতায় পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে…
দেখছে নতুন বউ, যার
স্বামী এখনও ফিরল না।
তবুও বলছি তোমায়
লক্ষ্মীটি, ভাবো রাত্রি এলে
ফিরবে কোথায় ?
অন্য অনেক গাছ
ফেরাচ্ছে সব পাখি। গাছেরও
তো বউ-ঝিউড়ি থাকে।
কোথায় এমন আছে
মোহনচূড়ার জন্য শুধু
মোহনচূড়া ডাকে ?
বেশ। কিচ্ছুটি বলব না
দুঃখ খুঁটে খাই, আমি
অরূপে যাই চলে—
ক্ষতি কীই-বা বলো
নাহয় স্বপ্নে তুমি আমার
মোহনচূড়া হলে !
দেশকাল
আমি যা নদী ও নৌকা বানালাম,
এতদিন আমি যা আকাশ মাটি পাহাড় সমুদ্র বানালাম,
আমি যা বসনপ্রীতি আর
দুঃখের মাধুরী গড়লাম,
যেটুকু সৌন্দর্য প্রবেশ করিয়েছি প্রেমে ভালোবাসায়
আর আমি যেটুকু প্রতিরোধ খাড়া করেছি
সেসব শব্দে গড়া।
এখন তোমাদের কাজ হল—
সেসব বস্তুধর্মে রূপান্তরিত করা।
কোনও মুহূর্ত আমি সঠিক অর্থে হারিয়ে ফেলিনি
আমার এই হাত সঠিক বন্ধুর চেয়েও
বিশ্বস্ত আর পরাক্রমী, নীলিমায় নীল
আমার এই অলিন্দে দেখো খুলে গেছে দয়ানদীধারা…
আমার এই চোখ জুয়াড়ি নক্ষত্রের আগুন ভরা
মহাজাগতিক আশ্চর্য এক ফসিলের অংশ স্বরূপ
আঘাতে হই না আর কোনও কবির বিষণ্ণ পদাবলি…!
আমার সমগ্র জীবন ধ’রে ঘটে চলেছে আমার সমগ্র মৃত্যু
এখন আমার চাওয়া বলতে শুধু এই:
আমার সমগ্র জীবন ও আমার সমগ্র মৃত্যু
শুধু সেই মুহূর্তের অপেক্ষায় আছে
যখন ছাই ও প্রস্তর থেকে
আবার ঠিক বেঁচে উঠব আমি,
কোনো আগুন আমাকে পুড়িয়ে দিতে পারে না !
পূর্বাপর বৈশ্বিক হয়ে উঠতে চেয়েছি
ত্রিকালের যে-কোনো চিন্তায় এনে ফেলছি মহামাত্রা
আমার প্রকৃত কোনো দেশ নেই
যেমন কোনো সূর্য পাখি আপেলের দেশ নেই
যেমন কোনও প্রতিভারও দেশ নেই
তবু চেয়েছি আমার ভিতরে গড়ে উঠুক একটা দেশ
কথা বলতে পারা গোলাপের দেশ !
আমার যেমন স্বপ্ন আছে আমার তেমন নিঃস্বপ্নও আছে
আমি কি পেরেছি ভিক্ষু হতে, তোমাদের প্রেমের দুয়ারে?
হে অপ্রসন্ন ঈশ্বর, অসংকলিত প্রেমই আমার যুদ্ধ—
নিয়তিবাদ নিপাত যাক—
আমার রক্তে লেখা হোক ফুলেদের নতুন বর্ণপরিচয়।
মৃত্যুর প্রশাখায়-প্রশাখায় বেঁচে
বস্তুত সবই আমি গোলাপে ও তৃণে চালিত করেছি !
ছবি – রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর