রহিত ঘোষালের কবিতা

কাগজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ

বিকেল তখন খুব কাছে—
একটি দুপুরে পোড়া বাসস্ট্যান্ড
আমাকে নিয়ে ডুবে যাচ্ছে,
রাস্তার ভাতের হোটেল কুড়িয়ে কাঁচিয়ে
শেষ হাতা ভাতটুকু দিয়ে ফিরছে,

কাকপক্ষীদের জমায়েত

আলো কমিয়ে আনছে,

কৃষ্ণচূড়া পাতা ফেলে দিচ্ছে তেষ্টায়

—ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ,

শ্যামলা ভাঙা ব্রিজের ধারে মালতী গাছ,

একদৃষ্টিতে জাহাজঘাট তাকিয়ে আছে—
ছানিপড়া চোখের কোটর তার,
শ্যাওলাধরা রোঁওয়া-ওঠা দেহ নিয়ে
যুবক-যুবতীদের উঁচু নীচু সেলোফেন কাগজের

অঙ্গ প্রত্যঙ্গের দিকে

প্রকৃত আমি

আমি অন্তত এমন এক মহাদেশে থাকি না
যার অরণ্যগুলি এক-একজন মানুষের ব্যক্তিগত
সম্পত্তি

আমি কিছু স্বপ্ন ইন্দ্রলোকের
জল দিয়ে ধুয়ে নিতাম,
কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে
তারা গুনতাম, সামুদ্রিক ফেনা পা ছুঁয়ে
রাতের সাথে রাতের এক চুম্বন দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে
থাকত, হাওয়ায় উড়তে উড়তে পতঙ্গের দল
জ্বর নিয়ে আসত মাথার পাশে,
আলোকিত সে জ্বর

গভীর খাদে পড়ে একটা ফানুস
ছটফট করতে করতে প্রাচীন চিহ্নের কাছে
আত্মসমর্পণ করলে আমি মসৃণ মাটিতে
পুঁতে ফেলতাম হাড়, পেছনে ফিরে দেখতাম
দূরের জনবসতির টিমটিমে আলো,
তাদের সমস্ত অস্তিত্বে লেগে আছে
ঘৃণ্য বিষবীর্য,
হায়েনার পাকতন্ত্র ছিঁড়ে ওরা কাঁচা খাচ্ছে,
ওদের দেবদেবী করোটি রঙের ভস্ম মেখে
জন্ম দিয়ে চলেছে নরকের প্রহরীদের,
বড় উদাস কুম্ভীপাক নাকি রৌরব ওদিকে?

কিছু বুঝে উঠবার আগেই

এক ঝড় এসে আমাকে
খণ্ড খণ্ড করে যায়,
সেই প্রথম আমি মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখলাম,
সেই প্রথম আমি মৃত্যুকে পিছন থেকে দেখলাম,
সেই প্রথম আমি মৃত্যুকে উপর থেকে দেখলাম,
সেই প্রথম আমি মৃত্যুকে নীচ থেকে দেখলাম,
আমার চারিদিকে মৃত্যু নেচে বেড়াচ্ছে,
অন্ধকারে বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা
হাতের পাঞ্জা খুলে গলা টিপতে আসছে,
তাদের দিকে মশাল ছুঁড়েও
আমি প্রতিহত করতে পারিনি,
কষরক্ত চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
তবু তো নিঃশ্বাস একমাত্র সম্বল,
উঠে দাঁড়িয়ে আবার দৌড় দিয়েছি,
আমার হৃদপিণ্ড তখন হাতের মুঠোয়,
সে রাতে আশ্রয় পেয়েছিলাম শিয়ালের গর্তে,
অথবা ছিনিয়ে নিয়েছিলাম
অবলা প্রাণীর বাসস্থান,
ঠিক সেদিন থেকেই আমাদের আর ওদের
মধ্যে কোনও ফারাক রইলো না,
খুব অল্পদিনেই আমরা নিজেদের
ধরে রাখতে পেরেছিলাম,
খুব অল্পদিন আমরা প্রকৃত আমাদের মতো ছিলাম

 

তারপর ঘনিষ্ঠতা

আমার ঘুমের আগে
ধীরে ধীরে আলোবৃক্ষ থেকে
প্রাণবন্ত শিখা অনুভূতির কাছে
ভাঙছে
ওখানেই চিন্তামনি কর
বসে থাকেন
ঘুমের আগে রাত সরে যেতে থাকে
রেল ব্রিজের উপর শুয়ে থাকে খসখসে শরীর

ইটভাটার গান

এক ভীষণ অজানার হাতে
নিজেকে তুলে দিয়ে
নদী-পুলের ওপর শুয়ে আছি
অস্বাভাবিক দ্রুত চলে যাচ্ছে দিন
মাছরাঙা পাখির চোখে
আমি রেখেছি অবসাদ
কালো কালো জঙ্গল
এক নিশ্চিত দুর্ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী
আলগা হয়ে আছে সম্পর্কের দড়ি
বেফাঁস শিলাবৃষ্টি
কাচ ভেঙে দিচ্ছে চশমার

দ্রুত চলে যাচ্ছে দিন

অনসূয়া

ঝর্ণার জলে স্নেহভাষা পেয়েছি
তোমার কমলে হতাশা নক্ষত্র
এ আনাগোনা সঙ্কেত রেখে যায়
আত্মগ্লানির—
অক্ষর কোলাহলে শৃঙ্গ ভেঙে যায়
জড়ানো জড়ানো‌ কথা
প্রবঞ্চক অভিপ্রায়
প্রলাপের সিঁড়ি আমার সৃষ্টি
তুমি তার কিছুই জানো না
ধরাশায়ী নেশার শকুনের পাল
কিমাকার বিমূঢ়তা দিয়ে যায়
উপত্যকায় পরোয়াহীন আঙুরখেত
ফালাকাটায় এখন জীয়ন্ত বউল সমাহিত
পরিব্রাজক গাংচিল এনেছে সূর্যাস্ত
খরজলে ভারহীন শরীর
নিঃসাড় সবুজ ছাইভস্ম
খাঁ খাঁ মরু-পাঁজর
রতিসুখ মাখা সতী নৌকা
এসো বজ্রবৃষ্টিচোর
এসো মণিমাণিক্য প্রদীপ
উন্মাদিনী মায়ের বৃন্ত থেকে
ঘুম তুলে আনি

 

ছবি – গনেশ পাইন

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By রহিত ঘোষাল

দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ এলাকায় ১৯৯০ এর ৯ অক্টোবর রহিত ঘোষালের জন্ম,সেখানেই শৈশব ও কৈশোর ব্যয় করেন। লেখালেখি করছেন ২০০৭ সাল থেকে। জীবনের বিচিত্র সব শিল্প সংস্কৃতি সংক্রান্ত কৌতূহল ও স্বপ্ন মেটাতে ও বাস্তবায়ন করতে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা কলেজ অব্দি। বিভিন্ন রকম পেশা বদলে বর্তমানে একটি ব্যক্তি উদ্যোগের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কবিতা লেখার আশেপাশে অভিনয় করেছেন মঞ্চনাটক ও অন্তরঙ্গ নাটকে। গান গেয়েছেন এবং লিখেছেন নানা বাংলা ব্যান্ডের দলে,অবসরের ছবি আঁকতে ভালোবাসেন আপন মনে। প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই- "পীড়িত অববাহিকা" প্রকাশ পায় ২০০৩ সালে ।

Leave a Reply