রেল গাড়ি
প্রতিদিন যারা রেলগাড়িতে যাতায়াত করেন, তারা জানেন কখন কথা বলা থামাতে হয়। ঝগড়া করতে করতে আচম্বিতে বান্ধবীকে দেখলে এক গাল হাসি দিয়ে ঢেউ খেলাতে হয়।
রেল গাড়ি জানে কখন দুটো লাইন মিলিয়ে মাঝ বরাবর গতি বাড়াতে হয়। রেল গাড়ি জানে ; কখনো ছেলেদের আলাদা কম্পার্টমেন্ট থাকতে নেই, নাহলে বড্ড বোরিং হবে। এই রেল গাড়ি আমাকে যে কত কিছু শেখালো, দেখালো আমি ভেবেই আকুল। রেল গাড়ি তে কতদূরে গিয়েছি কতদূরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এই রেল গাড়ি নিয়ে রবি ঠাকুর আস্ত একটা কবিতা লিখেছিলেন। যা এখনো আমাদের মনে প্রেমের ভাব জাগায়। সত্যজিৎ রায় চমৎকার একটি সিনেমা বানালেন ; নায়ক।
এই ট্রেন থেকে আবার কখনো নামতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় বসে থাকি, ঘুমোয়ই, উল্টোদিকের সিটে পা তুলে বসি। এই তো বেশ দিন কাটছে। আমাদের ধ্যানবিন্দু’র উল্টোদিকে ‘স্টুডেন্ট কর্ণার’ এর বাপি দা’ বেলঘরিয়া থেকে ট্রেনে উঠে সিটে যে বসলেন ; আর নামলেন না। শুধু নামানো হল তার ডেডবডি। তিনি ঘুমের মধ্যে মারা গেলেন।
একবার উলুবেড়িয়া স্টেশনে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকা ভদ্রলোক বাড়িতে ফোন করে বলছেন, লাইনে আমার পা দুটো চলে গেছে…
ভোগপুর স্টেশনে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে লাইন টপকে বাবার থেকে গোলাপ ফুল নেবে বলে ছেলে দৌড়ে আসছে। বাবা ফুল বিক্রেতা। সেদিন ছিল ১৫ অগাস্ট। একটা মেইল ট্রেন বাবার স্বপ্নকে খানখান করে দিয়ে চলে গেল। আমরা চেয়ে থাকলাম। ছেলেটার মুখের সমস্ত আনন্দ আকাশে বাতাসে মিলিয়ে গেল।
এইভাবে কত মানুষের প্রাণ যায়। তবুও রেলের ভূমিকা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। রামরাজাতলা স্টেশনে ট্রেন এলে সনু বাঁশি বাজায় চিৎকার করে। নিজে নিজেই হাসে। একবার সনুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সনু তোর বাড়ি কোথায়? বলেছিল; রেললাইনে।
ক্যানিং স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম তো যেন ওল্ড দীঘার খাওয়ার মেলা । কতরকম যে খাওয়ার পাওয়া যায়। এই রেল নিয়ে একখানা আস্ত বই লেখা যায়। লোকাল ট্রেনে কত বই পড়েছি, তার ইয়ত্তা নেই।
এই লোকাল ট্রেনে, প্ল্যাটফর্মে অনেকের প্রেমে সেই মুহূর্ত রঙিন হয়েছে। তারপর আর দেখতে পাইনি। পরে হয়তো দেখেছি অনেক বছর পর, সে তার সন্তানকে বোঝাচ্ছে, আদর করছে।
আমি তো বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে থাকি এক রেল গাড়ির দূরত্ব।
স্কুল পাশ করার পর যখন খুব মন খারাপ করতো, মনে হতো আমাকে কেউ ভালোবাসে না। তখন কোলাঘাট স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বসে থাকতাম। মনটা ভীষণ ভালো হয়ে যেত, এই তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের প্রাণ আছে। বৈদ্যকাকু চা দিয়ে যেত, অপূর্ব ছিল সেই চা। এখনো সময় পেলে গিয়ে বসি খড়দহ স্টেশনে। আরও একটু সময় থাকলে বেলঘরিয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মও বেশ লাগে।
আমার মনের মধ্যে একটা আস্ত ট্রেন আছে, প্রাক্তন প্রেমিকাকে দেখলে সেই ট্রেন হু হু করে ছুটতে শুরু করে। থামে এক নির্জন স্টেশনে। তখন নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।
সবসময় তো এক লাইন আরেক লাইনে মেশে না।