জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের গল্প

একাকী দ্বৈপায়নে মগ্ন

 

বানশীর তীব্র চিৎকারে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে দৃশ্যাদৃশ্য।

ঝাপসা দেখলে হাতটা নিজেই এগিয়ে যায় কাছাকাছি চশমাটার দিকে। অতঃপর খেয়াল হয়… নেই। নিষ্প্রয়োজন।
অনেক ওপর থেকে উজ্জ্বল আলোর গোলক। উপস্থিত ধরিত্রীর একমাত্র উপগ্রহ, অথবা নিকটতম নক্ষত্র থেকে ধেয়ে আসা আলোকরশ্মির ন্যায় উজ্জ্বল।
অথচ ঝাপসা।
ক্রমে অনুভব করি, এ বায়ুমণ্ডলে এক অদ্ভুত আন্দোলন, সেই আলোক উৎসও তাতে দুলছে। আসলে বায়ু নয়, জলতল থেকে দেখছি এসব কিছু।

“Everything changes, but stays in another form…”

কত কিছু বলেও মনে থাকে না তোমার… মনে থাকে না। মনেই থাকে না!
আমি একটা দিনের অপেক্ষা করে আছি… যে দিন আর সব জিজ্ঞাস্যের আলাপ আরোহন থেকে উঠে এসে জানতে চাইব– বলা-ই বা কেন?

এই অপেক্ষাও হয়ত অজুহাত। আর না বলতে পারাটা লোভ। যার থেকে মুক্ত হতে পারিনি।
এই যে বলছ– একেই নজরানা অথবা মাধুকরী অথবা শরনার্থীর থালায় খুদের মতো ধরে রাখা। সামলে রাখা। এইটুকুই সঞ্চয়! সম্বল!

কিন্তু আমি কিছু ভুলে গেলে ক্ষমা করো না কখনো… মনে করিয়ে দিও ভর্ৎসনা সহকারে!

এই যে মনে করিয়ে দেওয়ারও দায় নেই।
এখান থেকেই ‘নেই’… ‘নেই’… ‘নেই’ চতুর্দিকে ঠোকা খেতে খেতে প্রতিধ্বনিত হয়।
আর সেই বহুচর্চিত তিন ডাইনী এই নেতি-অনলের লেলিহান শিখা থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে ঘিরে ধরে তিন দিক থেকে খোনা গলায় সুর করে বলে —

— প্রত্যাশা করেছিলে?… হা হা হা!… কেন?!

— প্রত্যাশা করতে কেউ বলে না। যে করে, সে ভুল করে করে।

— যে নিজে যেতে চায়
যে অনুরোধ করে
যে প্রত্যাশা করে
যে প্রতীক্ষা করে
যে প্রত্যাখ্যাত হয়
সে দুর্বল।
সে-ই দুর্বল। বোকাও।

প্রত্যাশিতভাবেই, সব বক্তব্য শেষ হওয়ার পর তারা মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে, প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায়।
আমি কেবল স্মিত হেসে বলি– বেশ।
এটুকুই তো বলে এসেছি, অন্য কাউকে… অন্য অনেককেই। নিজেকেও।

এর পর পরামর্শের পালা, যখন ডাইনী-রা বলবে– অতঃপর কী করণীয়। একটা ইঙ্গিত দেবে ভবিতব্য এবং কর্তব্যকে চেনার।
আর আমার মনে পড়ে কুরক্ষেত্রর যুদ্ধ সমাপনে যুবরাজ দুর্যোধনের কথা। দ্বৈপায়ন হ্রদে মগ্ন দুর্যোধন।
প্রবল কেঅসের মাঝে কল্পনা করি– এভাবেই চারপাশে জলরাশি। মগ্ন দুর্যোধনের ন্যায় বসে আছি। ডাইনীরা অনেক চেষ্টা করেও তাদের পরামর্শ আমার কান অবধি পৌঁছে দিতে পারছে না।

হয়ত শুনলেই ভালো হত। অন্ততঃ একবার যদি শুনতাম– নতুন আর কীই বা বলার আছে তাদের? কীই বা থাকতে পারে বলবার?
আমাদের যৌথ ব্যর্থতা বুদবুদ কেটে ডুবে যায় দ্বৈপায়ন হ্রদে। অন্য এক অরচিত পর্বের অন্তরালে।

অদ্ভুতভাবেই, এই জলস্তরের মধ্যে থেকেই অনতি দূরে একটা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ চলে যায়… দূরে থেকে কাছে আসে, আবার দূরে সরে যায়। নৌকার বৈঠা বাওয়ার শব্দের মতো।
আর নিবিড় নৈঃশব্দ্যমাঝে কেউ ডেকে ওঠে– ইয়াকুব… ইয়াকুব।
এত রাতে কোন পাখির ঘুম ভেঙে যায়, বুঝতে পারি না। অনুমান করে নিই কোনো প্রজাতির পেঁচাই হঠাৎ এভাবে ডাকতে শিখেছে।
যেমন কোনো কোনো মানুষের ডাকও, তার চারপাশের অন্যদের মতো হয় না। তার কথা, তার প্রকাশ… অন্যরা অর্থ খুঁজে পায় না। চায়ও না… অর্থ খুঁজতে। অস্বীকারও করে।
অথচ আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি… ইয়াকুব… ইয়াকুব… ইয়াকুব।
আগে ভাবতাম বেশির ভাগ মানুষের ইচ্ছে নেই… ক্রমে অনুভব করি– মন নেই।
মন-ই নেই… খোঁজার। বোঝার।
যাদের মন নেই, তাদের থেকে দূরে সরে আসতে আসতেও এই দ্বৈপায়ন হ্রদ রিফিউজ হয়ে যায়। কথা আর ব্যাখ্যা দুই-ই অপচয়… যেখানে মন নেই।
চোখ বন্ধ করে শুনি… পাখি একমনে ডাকছে– ইয়াকুব… ইয়াকুব… ইয়াকুব।

ফ্রেডরিক ফোরসিথের বিখ্যাত উপন্যাসের শেষদিকে, রাষ্ট্রপধানের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত বুলেট ধেয়ে আসে এক জনৈক কর্তব্যরত শান্তিরক্ষকের বুকের পাঁজর ভেঙে দিতে।
আর সেই হতভাগ্য অন্তিম মুহূর্তে জিভে নোনতা স্বাদ পায়। মনে পড়ে সমুদ্রের লবনাক্ত জলের কথা।
চতুর্থবার স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার সময়ে যে সমুদ্র-সৈকতে বসেছিলাম। সেখানে আমার পাশে বসে থাকা কুকুরটির কথা মনে পড়ে।
আমি মোটামুটি নিশ্চিৎ করেই ফেলেছি… মনে হল ও আর আমি, দুজনেই জানি না– কোথায় যাব। একটু তলিয়ে ভাবলে দুজনেই জানি না– কেন এসেছি।
আমি জানি না, মানুষ খেয়াল করে কি না… এত পরিবার, সম্পর্কের বুদবুদ ভাসিয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে,সানন্দে সকাল থেকে বিকেল অবধি বালি আর নোনাজল মেখে যারা প্রতিদিন আসে আর যায়… তারা খেয়াল করে কি না– কী অদ্ভুত শান্ত দার্শনিক দৃষ্টি নিয়ে জন্মেছে এমন কিছু কুকুর, যারা সূর্যাস্ত থেকে সন্ধ্যা অবধি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।
সেই সব কুকুরদেরই একজন এবং আমিও… আমরা হয়ত কখনো সামান্য প্রত্যাশায় থেকেছি, একটা হাত মাথায় রেখে চলে যাক কেউ। একটা হাত একটু বেশিক্ষণ মাথায় অথবা পিঠে রেখে দিক।
বিস্কুটের থেকে সেই স্পর্শ বেশি কাম্য ছিল। প্রাপ্য। প্রত্যাশিত। দাবী?
আমরা চাই না। আমরা… হয়ত সঠিক পদ্ধতিতে চাইতেই অক্ষম। সঠিক প্রক্রিয়া, সঠিক আচার… এইসব কিছু থেকে অজ্ঞান। নিতান্তই অযোগ্য। অনুত্তীর্ণ ।

এমন দু-হাত বারিয়ে বসে থাকা সাধারণ সারমেয় জীবের সামনে, আরো সাধারণভাবে দু-হাত বাড়িয়ে বসে থাকি এমন জগৎবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সন্ধ্যায়।
মিশরীয় দেবতার মতো বালির ওপর ফুটে ওঠে আমাদের অবয়ব।
কেউ কি দেখে?… কেউ কি মনে রাখে?

বানশীর তীব্র চিৎকারে সে দশা কাটে।
হ্রদের জলরাশি মাথার ওপর টলটল করে। চোখের পাতা ভারী হয়।
কারো চূড়ান্ত অপমান অথবা অবহেলা অসহনীয় হয়ে উঠলে… পালটে উত্তর দেওয়ার আবশ্যিকতায়, অথবা সেই উত্তরের অজুহাতে অন্য পথ খুঁজে নেওয়ার একটা উপায় হয়ে যায়। যেমন দুর্যোধনের হয়েছিল। সে স্পষ্টই জানত, এর পর কী হতে চলেছে। কর্মফল… অথবা দৈব, অথবা পূর্বনির্ধারিত– এইসব কিছুই বিজয়ী পক্ষের অনেকের থেকেই ভালো জানত।

আলোকময় বৃত্তের দিকে তাকিয়ে থাকি। জলতরঙ্গে দদুল্যমান আলোকবৃত্তের মায়াবী রূপ। অথচ ঝাপসা।
মনে পড়ে যায়– কৈশোরে প্রথম দৃষ্টিশক্তিকে সন্দেহ করেছিলাম, যেদিন আকাশের অর্ধচন্দ্রকে ইশৎ ঝাপসা মনে হয়েছিল– একটি প্রধান এবং দুপাশে দুটি হালকা কায়া, অধিক্রমণরত।
আকস্মিক ভাবে স্মরণে আসে– কোনো কালে দেখা এক তীর্থংকরের ভাস্কর্য। নাম– চন্দ্রপ্রভ।

আলোকময় বৃত্ত… পৃথিবীর একাকী উপগ্রহের ঝাপসা বিম্ব। তাকে প্রেক্ষাপটে রেখেই তিনজন ডাইনীর আন্দোলিত মুখাবয়ব আমার দিকে নেমে আসে–
তাদের বহুপ্রতিক্ষিত পরামর্শ… আমাকে দান করা এখনো বাকি আছে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply