আমি ভালোবাসি ! বলতে পারি না। যেদিন বলবো, এত ঘৃণা দেখেছি তার চোখে। উত্তর দেয় না। পাহাড়ের কাছে গেলে মানুষ সবসময় উদার হয় না, যখন ভেবেছি নিজের করুণ দুই চোখ দেখে বিস্মিত হয়েছি। লোক ভর্তি ট্রেনে কেমন একা অসহায় মনে হচ্ছিল ! এই বুঝি লাফ দেব… শেষ মুহূর্তে বাঁচার তীব্র আকুতিতে পারলাম না। কেন বেঁচে আছি ? শুধু একটি প্রেমের হেলাচ্ছেদ্দ্যায় এমনটা কেন মনে হচ্ছে! যখন হাওড়ার ১০/১০ ঘরে ভাড়া থাকতাম, তখন কত সু্দর জীবন কাটিয়েছি। নতুন কিছু করবার কথা ভেবে রাস্তায় সাইকেল নিয়ে ঘুরেছি। পৃথিবীতে এতো পথঘাট আছে যা একান্ত প্রেম ও বিরহের এটুকু বুঝেছি। তখন নিয়মিত শিবেন্দু মান্নার বাড়িতে যেতাম।
হাওড়া শহরে গলি আমাকে প্রেম করার প্রস্তাব দিয়েছে। এতোটা নিরাপত্তা ভালোবাসা পেয়েছি ভাবলে কষ্ট হয়, এইভেবে যে আমি এখন হাওড়াতে নেই।
মাধ্যমিক দেওয়ার পর রামরাজাতলায় গোপাল লাল শেঠ লেনে সাধনা ডায়াগনস্টিকের ঠিক উল্টোদিকে পুষ্পা ইন্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে মাত্র ১৭ বছর বয়েসে কাজে লেগেছিলাম।
তার আগে এপ্রিল মাসে ২২ তারিখে দেখতে এসেছিলাম কেমন কাজ ? কী করতে হবে ? এইসব। দেখার পর আমার কোনোভাবে কাজে যোগদান করার ইচ্ছে হচ্ছিল না। স্বপ্ন ছিল সারাজীবন পড়াশোনা করবো, লেখালেখি করবো। ঘরময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে বই। সেই স্বপ্ন অনেকটা মন্থর করে দিল আমার বাবা-মা। আমার যে কতটা ক্ষতি করেছে, বলে বোঝাতে পারবো না। আমি তো ক্লাস সেভেন থেকেই বাড়িতে আর্থিক সহযোগিতা করতাম। সেইসময় আমার বংশের লোক যারা আমাকে নানান ভাবে ব্যাবহার করেছে। আমাকে মানসিক ভাবে আঘাত দিতো। আমি লুকিয়ে কাঁদতাম। সেই মনের সঙ্গে আজকে প্রায় ১৯-২০ বছর পরও কথা হয় আমার। অবাক লাগে সেই মন একটুও বদলে যায়নি। ঈশ্বরের অসীম কৃপা, আমি একই রকম আছি। বাড়ির অশান্তির জেরে ২০০৭ সালে পয়লা জুন আমি কাজে যোগদান করলাম। প্রচন্ড হাড়ভাঙা পরিশ্রম, আমাকে একটু একটু করে শারীরিকভাবে বদলে দিল। প্রতিদিন সকালে আটটায় কাজে ঢুকতাম, বেরোতাম সন্ধে পাঁচটায়। মাইনে ছিল ৩০টাকা প্রতিদিন। প্রতি শনিবার ১৮০ টাকা পেতাম। তখন কাউকে পায়নি নিজের কথা বলার, সমস্ত শক্তি আমি সাহিত্য থেকে পেয়েছি। লুকিয়ে বই পড়তাম। রামরাজাতলায় আলাপ হয়েছিল বাবুল বোস, সাহিত্যিক দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ তালুকদার, শোভন চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রদীপ জ্যাঠু ‘জৈষ্ঠ্যের ঝড়’ পড়তে দিয়েছিল। আমি সেই বই পড়ে আমার এতো ভালো লেগেছে, জীবন আরও মজবুত হয়েছিল।
২০১১ সালে পয়লা আগস্ট আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল দিব্যেন্দু জ্যাঠু , রাতুলের সঙ্গে। রাতুল মন্ডল। ইছাপুরে বাড়ি। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আমার কাছের মানুষ। জীবন আরও এগিয়ে গেল। আমরা ‘ব্যাঙের ছাতা’ পত্রিকা শুরু করলাম। রাতুলকে প্রায় বলতাম, কারখানার কাজ আর ভালো লাগছে না। কোম্পানির মালিক নবীনকুমার কে প্রায় বলতাম কাজ ছেড়ে দেব, ছাড়তে আর পারতাম না। অবশেষে মন শক্ত করে, ২০১৫ সালে পুজোর আগে কাজ ছাড়লাম। কোম্পানি কে বললাম, আমাকে বোনাস দিতে হবে না। ওরা চাইছিল না, আমি কাজ টা ছেড়ে দিই। নানানভাবে ভয় দেখালো “কী খাবি, বাড়িতে ছোট ছোট ভাইবোন। বাবাটা তো কাজ করে না।” আমি ভালো লাগছে না বলে বেরিয়ে এলাম। শুরু করলাম ট্রেনে বই বিক্রি। দেখলাম রেলের আরপিএফের কদর্যতা, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী। আমি খুব গর্বের সাথে রেলে হকারি করছিলাম। তখন আমায় মানসিক ভাবে শক্তি দিতো বিবেকানন্দ,রবীন্দ্রনাথ, সমরেশ বসু। আমার সবসময় পাশে ছিল, আমার অকৃত্রিম বন্ধু রাতুল মন্ডল। আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। এতোটা মনে হয় আমার বাবা মা ভালোবাসে না। তাঁরা শুধু মাসের শেষে টাকার জন্য অপেক্ষা করতো। এখন হয়তো ততোটা করে না, কিন্তু করে।
রবিবারের আলাপ সালাপ : পর্ব – ০৪
