প্রতীকী ছবি

সে বাড়ির ঝাড়লণ্ঠনগুলো থেকে থেকে বেজে ওঠে। কেউ বাজায় তাদের, আপ্রাণ বাজিয়ে চলে নিজেরা বাজবে বলে। কেউ কখনো তাদের দেখে না, কেউ টের পায় তারা মাঝে মাঝে জেগে ওঠে, বেজে ওঠে, প্রাণপন ফুঁড়ে যায় নিজেদের, আর খোঁজ করে চলে, গঙ্গার পাড়ের এই একানে বাড়িটার গায়ে।
এ বাড়ির বয়স কম করে বছর আশি। থাকেনা কেউই, তালা ঝোলে কতকাল ধরে কে জানে। তাও অলিগলি দিয়ে ছেলেপুলে ঝাড়ি করে, দালান বেয়ে ঢুকে কেউ তাস খেলে। আবার কেউ কেউ না-বলা শরীরের এলোমেলো কথা বলে চলে যায়। তখন আবার ঐ বাড়ির কোন কোন কোণা জগতের খোলামেলা গন্ধে ভরে ওঠে, তৃপ্তির ঘামে ভ‍্যাপসা দেওয়ালগুলো হঠাৎ করে জ্বলে উঠতে থাকে দপ দপ করে। অনেকে সাপের ভয়ে ও দিক মাড়ায় না। তাতে একদিক থেকে ভালোই কারোর কারোর জন‍্য। যারা নিতান্ত পুড়ে চলা ইচ্ছাতে ছাড়খার হয়ে আসে, ও বাড়ির দালান কোঠা কিংবা কোনো সিঁড়ির গায়ে, তারা আশ্রয় নিতে পারে। তেমনই সেবার এক চৈত্র পূর্ণিমার রাতে, কারা জানি ঢুকে পড়েছিল ওরকম এক সিঁড়ির গায়ে। তারা জানত না তারা কী চাইত। এও জানত না তারা পথ ভুলে গিয়ে এসে পড়েছিল, নাকি জেনেশুনে। তারা জানত শুধু দুজনে দুজনকে পেতে চায়, একে অপরকে পেয়ে কোন শুদ্ধতম নিজেকে জড়াতে চায় আরো গভীরে। ওরা ঐ সিঁড়ি খুঁজে বের করে, আশ্চর্য সিঁড়ি ছিল সেটা। রেলিং জুড়ে বিলিতি ফুলকাটা নকশা, আর দেওয়াল জুড়ে মাকড়সার জাল জড়ো হয়ে হয়ে তৈরী হয়েছে সোঁদা দৃশ‍্যপট। তার সামনে দাঁড়ালে ঘনীভূত হতে থাকে সময়, ধোঁয়ার কুন্ডলীর মতো গুলিয়ে উঠতে থাকে অবসন্ন সব ইচ্ছার ঘোরপ‍্যাঁচ। ওরা ঠিক করে খুঁজে দেখবেই এ সিঁড়ি কোথায় যায়, আর কোথায় নিয়ে গিয়ে আজ তাদের ফেলে।
পূর্ণিমার রাতে গঙ্গায় তখন হেউঢেউ জোয়ার।একূল ওকূল জোৎস্না মাখছে নদীর ভরাভর্তি দেহ। ওরা কোন এক ফটকের ঝাঁঝরি দিয়ে তাই দেখে। আর আঙুল দিয়ে ফুঁড়ে চলে মাকড়সার জালের স্তরের পর স্তর। টর্চ আর ঝাঁঝরির জোৎস্নায় আলোয় কুলিয়ে যায়। ওরা নিজেদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে জাল ভেঙে চলে যায়। গিয়ে একটা ন‍্যাড়া চাতালে ওঠে। সিঁড়ি আর ঐ ছাতের মাঝে দুমড়োনো খিলান সমেত একটা চিলেকোঠা মতো আছে। খিলানের শিঁকগুলো প্রায় বেরোনো, তাও তার ফাটা ছাদে ভাঙা একটা ঝাড়লণ্ঠন দোল খাচ্ছে গঙ্গার আর্দ্র বাতাসে। ওরা নিজেদের খানিক জুড়োয় সেখানে। নদীর হাওয়ায় খানিকটা সিক্ত করে নেয় নিজেদের। উঁচু থেকে জোৎস্নায় থইথই করা এমন রাতের নদী ওরা কখনো আগে দেখেনি। ওরা দূর থেকে দেখে যায় আর ভাবে, এই নদীর নিঃসীম ঘূর্ণাবর্তের মতো করে কি করে ওরা এসে গেছে দুজনে দুজনের কাছে। কেউ কি কারোর খোঁজ পেয়েছিল? কে জানে। ওরা নিজেদের অজান্তে নিজেদের পেয়েছে। একে অপরকে পেয়ে আরো বেশি করে নিজেকে টেনে নিয়েছে কাছে। ওরা আসলেই অলৌকিক স্রোতে ভাসছে। অপরিবর্তনীয় কোন নিটোল রহস‍্যে ভাসছে। কিন্তু তার আর খোঁজ পায় না। যেভাবে প্রেমে পড়ার পরদিন থেকে নিজেদের খোঁজ হারিয়ে ফেলেছে অপরকে খুঁজতে, ঠিক তেমন করে খোঁজহারা হয়েছে এই বিপুল রহস‍্যের ধারে। ওরা মনে মনে ভাবে, ভালোবাসা এইখানে সমাহিত হলে তারা তক্ষুণি বেঁচে যেত।
তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে প্রায়। ওদের শরীর বেয়ে বইতে থাকে পূর্বজন্মের আশ্লেষের স্মৃতি। মাঝের সব সময় ক্ষইতে থাকে ওদের তন্দ্রার গায়ে। মনে হয় এই চাতালের ধুলোবালি মাটি আর এই নদীটাই বুঝি জন্মে জন্মে সত‍্যি হয়ে এসেছে ওদের কাছে। বাকি সব কল্পনা ছিল। নিছক ধাবমান কল্পনা। সেটুকু দিয়ে কেবল ওরা টের পেয়েছিল যে ওরা একে অপরের জন‍্যে রয়েছে এই এক পৃথিবীতে।
রাত বাড়ে। সময় জিনিসটার মামুলি ধার দুজনের কেউই বিশেষ ধারে না। কাজেই ঘড়ি নেই। রাত কত হল বোঝবার উপায় নেই। শুধু সময় টের পায় তখন তখন ঝিমধরা দুটো শরীর বুঝতে পারে, পাপবোধ ক্রমশ বিদীর্ণ হয়ে চলেছে। একটা অদ্ভুত গন্ধ পায় ওরা। কিসের বুঝে ওঠে না। হতে পারে জোলো নদীর হাওয়ায়ই আরো গূঢ় কোন গন্ধ, কিন্তু ঠাহর করা সহজ নয়। আরো বেশি করে ওরা ভাবতে থাকে, এ বাড়িতে আর কখনো, কেউ, এর আগে ভালোবেসে মরেনি? বাড়িটার গভীর শরীরের দিকে আরো বেশি করে ওরা তাকিয়ে থাকে। দেখে ওদের নিভৃতি লালনে আরো কিছু কোথাও কেঁপে ওঠে কিনা। ওরা ভাবতে থাকে আরো ভেতরে ঢুকবে বাড়িটার। কিন্তু তাও আর হয়ে ওঠে না। বড্ড বেশি জোরে হাওয়া দিতে থাকে। ওদের প্রায় উল্টে পাল্টে উদভ্রান্ত করে দেওয়া হাওয়া‌। কিভাবে যেন কেঁপে ওঠে একতলার কোন খিড়কি। ঐ চাতালে ছড়িয়ে থাকা উড়ে যেতে চাওয়া শাড়িটাকে আবার পেড়ে আনে সেই ঝাড়লণ্ঠন কিংবা চিলেকোঠাটার কাছে। কেউ এল? ওদেরই মতোন কেউ আসতে তো পারেই। সদর দরজায় তালা দেওয়া বাড়িটাকে একঝলক দেখে কে বলবে যে অন‍্যপথে অনায়াসে ঢুকে পড়া যায়। কিন্তু তা যে যায়, সে তো ওরাই দেখেছে। অন্য কেউ যে আসবে না এমনটাই বা ভাবে কি করে! আবার আর এক পোচ গন্ধ পায়। মোম পোড়া চড়া গন্ধ। মোমবাতি কে জ্বালালো। তারা তো নয়, তবে কি কেউ ঢুকে পড়ল। এবার ওদের খুব ভয় করে। সত‍্যি সত‍্যি ভয় করে। সিঁড়ির সামনের যে খিলান ডিঙিয়ে ওরা এই চাতালে এসেছিল, সেখানে হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে। কিসের আলো দেখে না। তারপর দেখতে পায় ওপরের ভাঙা লণ্ঠন জীবন্ত হয়ে গেছে, আর তাতে মোম পুড়ছে দাউ দাউ করে। মোমপোড়া গন্ধে প্রায় ওদের দম আটকে আসে। ভীষণ হাওয়া ওঠে এই চাতালের পাশের পিপুল গাছ জুড়ে। আর সেই হাওয়াকে তীক্ষ্ণ ছুরির মতো ফালা ফালা করে কেটে যায় অপরিচিত রমণী কণ্ঠ। কোন উল্লাসে ভর করে সেটা ভেসে চলে যাচ্ছে। আর তাকে ছুঁতে চাইছে আরো কোন সমান্তরাল হাওয়া। এই দুই হাওয়ার কিছু যেন আশ্চর্য আস্ফালন আছে, ঠিক যেমনটা আছে ওদের দুজনকে নিয়ে দুজনের। ঐসব ঝোড়ো শব্দ মিশে যায় নদীর কলকলে আওয়াজের সাথে। তারা উদ্দাম হয়ে হাসে, কখনো কাঁদে, কখনো মিশে যায় একে অপরের সাথে। তারপর নেভার সময় জোরে জোরে জ্বলতে থাকে ঐ লণ্ঠনের কোলঘেঁষা মোমগুলো। ওরা বুঝে যায় যারা হাওয়া হয়ে এইভাবে হাসছিল, তাদের শরীরও গলে গেছে অনেক আগে এইভাবে। তাও তারা খুঁজে চলে, নিজেদের শেষ করে খুঁজে চলে এই উদ্ভ্রান্ত রাতগুলোর গায়ে। ঐ পাগলের মতো কেঁপে চলা এবার ছায়া ফেলে পুরো বাড়িটার গায়ে। ওদের ভয় পাওয়া কখন চলে গেছে। ওরা বুঝতে পারে, যা ঘটছে তা ওদের ইতিবৃত্তের কোন সমান্তরাল অতীত। আর ওরা সেই মূহুর্তে তার কোন অভাবনীয় উত্তরকালে দাঁড়িয়ে আছে।
মোমগুলো নিভে আসে। ওরা ভাবে আবার বুঝি সব আগের মতো হয়ে গেল। রাতটুকু এবার একটু ঘুমিয়ে কাটালেই হয়। দূরে কোথায় প‍্যাঁচা ডেকে ওঠে। আর ওরা শুনতে পায় নীচের কোন এক ঘরে ঝনঝন করে কাঁচ ভেঙে ওঠে। ওরা আর ভয় পায় না। বুঝে যায় ওদেরই মতো আরো যারা এ বাড়িতে ভর করে আছে। নিজেদের তারা তাই বাজিয়ে চলে, বাজিয়েই চলে ক্রমাগত। আসলে এই বাড়িটা এমন অনেকগুলো ব‍্যবচ্ছিন্ন সময় জমা রাখে। অতীত-উত্তর সবই নিজস্ব সময়ে ফুটে ওঠে, কখনো বা মিশে যায় একে অপরের গায়ে। ওরা বুঝে নিল তেমনই কোন অনামী আকাঙ্খার উত্তরকাল হয়ে ওরা আজ এখানে এসেছে। থুড়ি, এই বাড়িটা ওদের এনেছে। বাড়িটা বড়ো ভালো। ভালোবেসে এখানে মৃত‍্যুকেও জয় করা যায়। সময়কে উড়িয়ে দিয়ে ভালোবেসে ডুবে যাওয়া যায় ফুৎকারে। ওদের হঠাৎ মনে হয়, ওরাই তালে এখানে একা নয়, বা এইখানে এই প্রথম নয়।
এবারের শব্দ আরো জোরালো হয়, কোথায় যেন কি ভেঙে পড়ে চুরমার হয়ে। কিন্তু বোঝা যায় না। কে জানে এই বীভৎস চাঁদের আলো না কি এই ভরা নদী কি তাদের এতকিছু ভাবিয়ে তুলছে,কিন্তু বাড়িটা থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার কথা একবার ও ভাবাচ্ছে না। ওদের যেন মনেও হয় না যে এখনই কোথাও চলে যাওয়া যায়। মনে হতে থাকে এই আলো মেশানো আঁধারে রাতটা যেন চিরকাল ওদের এই ছাদটুকুতেই বেঁধে রেখেছে, আর আজন্ম তাই রেখেও দেবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি সময়টা ডেলা বেঁধে যায় এই মোমপোড়া গন্ধের সাথে। তালে এক্ষুণি ওদের মুক্তি হয়ে যায় স্থিত সময়ের কোন অবিশ্রান্ত শূণ্যে।
ওরা টের পায় না কখন থামিয়ে দিয়েছে এইভাবে ভাবতে থাকা। কেন তাও জানে না। জীবনের এতগুলা মূহুর্তে ভেবে যে সুখ কুড়িয়ে এসেছে আজ মনে হচ্ছে সব কিছুকে এই নদীর ঘূর্ণাবর্ত উথালপাথাল করে কেড়ে নিয়েছে। ওরা আর কিছু সত‍্যিই ভাবে না। কোথাও এইসব হাওয়াদের আকুল শব্দে নিজেদের জুড়ে নেয়।
কিন্তু সময় জেগে থাকে না সত‍্যি। পরদিন ভোর হয়। কেউ আর কোন গন্ধ পায় না, কোন শব্দ শোনেনা, নৌকোর ঘাটে মাঝি আর জেলেদের সোরগোল ছাড়া। রাস্তায় যেই আসে কি হয়েছে জানলে আকাশ থেকে পড়ে। পোড়ো বাড়িটার দোতলায় যে একানে চাতালটা, তার ঠিক নীচে আজ ভোরবেলা রসিদ মাঝি দুটি নরনারীর অক্ষত মৃতদেহ খুঁজে পায়, ঠিক যেমন তার বাবা পেয়েছিল, চত্তির পূর্ণিমার পরের ভোরে, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By সঞ্চারী দীর্ঘাঙ্গী

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ থেকে স্নাতক হয়েছেন, এখন চলচ্চিত্রবিদ‍্যায় স্নাতকোত্তর করছেন। অ্যাকাডেমিক নিবন্ধ লেখার পাশাপাশি কবিতা, গদ‍্য আর পেইন্টিং এ নতুন ভাষা খোঁজার চেষ্টা করছেন।

Leave a Reply