প্রথম পর্ব পড়ুন কালিকাপাতাড়ি: হাওড়া জেলার এক নিজস্ব লোক ঐতিহ্য
দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন কালিকাপাতাড়ি—দ্বিতীয় পর্ব: কেলকেপাতাড়ি
আজ থেকে চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত কেলকেপাতাড়ি সম্পর্কিত একটি রচনায় লিখেছিলাম যুগপরিবেশের সঙ্গে তাল রেখে রূপ পরিবর্তন মাত্র। সেটা ১৯৮৮ সাল। এর পর আরও দুটি যুগ কেটে গেছে। পঁচিশটা বছর। এই পঁচিশটা বছরে কেলকেপাতাড়ি নিয়ে কিছু সাংস্কৃতিক ঘটনাও ঘটে গেছে। এর বেশিরভাগ তথাটাই জমা আছে সরকারের তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তরের খাতায়। আর কিছুটা আছে রতনপুর গ্রামের কেলকেপাতাড়ি দলের পরিচালকদের মাথায়। আমরা যারা সাধারণ দর্শক হয়ে মাঝে মাঝে সেই নীলরাত্রির ভোরে উনাক্ত চত্বরে গিয়ে দাঁড়াই, তারা আজ কি দেখছি? উঠানের অঙ্গন মঞ্চে একটা স্বল্পদৈঘ্যর নাচ হয়ে যাবার পরেই মঞ্চটা চলে যাচ্ছে আটচালার ভিতরে। আটচালার কাঠামোর সঙ্গে টাঙানো হয়েছে বড় বড় লাল-নীল-হলদে-সবুজ আলো। যেসব আলো থিয়েটারের মত নিভবে জ্বলবে। চরিত্ররা সব যাত্রার ভাড়া করা ঝলমলে পোষাকে সেজেছেন, যা মধ্যযুগের শাসকচরিত্রগুলির অঙ্গে শোভা পেত। পৌরাণিক যুগের পোশাক বলেই এরা এগুলোকে মেনে নিয়েছেন। ফলে কি দাঁড়িয়েছে কেলকেপাতাড়ির চেহারাটা? এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাততালি পাওয়ার আকাঙক্ষায় জিমনাস্টিকের বাড়াবাড়ি। ক্যালেণ্ডারের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে মহিষাসুরমর্দিনীর পোজ দেখানো। ছৌ-এর অনুকরণে সিংহকে প্লাস্টিকের মুখোশ পরিয়ে তার পিঠে দুর্গাকে দাঁড় করিয়ে যুদ্ধদৃশ্য করা। এসব দৃশ্যের আয়োজন কেলকেপাতাড়ির মূল চরিত্রকে ক্ষুন্ন করে। তার আদিম ভয়াল আবহটাই রক্ষিত হয় না। কেলকেপাতাড়ির মূল আমেজ ছিল একাকী দর্শক অকস্মাৎ যেন কোনও নির্জন প্রান্তরে রাত্রিকালের আঁধারে মাখামাখি হয়ে এক অলৌকিক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার যে অনুভূতি তা রতনপুরের হাল আমলের নাচে পাওয়া যায় না। কেলকেপাতাড়ির কালীর মধ্যে যে চামুণ্ডারূপ প্রার্থিত, তার আভাসও থাকছে না এই থিয়েট্রিক্যাল বা যাত্রাটিক উপস্থাপনার কারণে।
এটা ঘটেছে শিল্পীদের বা শিল্পীদলের বা এক কথায় এই জনসমাজের অর্থনৈতিক পট বদলের কারণে। কেলকেপাতাড়ির শিল্পীরা এখন ইচ্ছা করলেই যাত্রার ড্রেস ভাড়া করার টাকা পাচ্ছেন, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মেকআপ-ম্যানকে দিয়ে নানান সূক্ষ্ম তুলির টানে চোখমুখ আঁকিয়ে তার পারিশ্রমিক গুণে দেওয়ার টাকা পাচ্ছেন। অথচ আগে এসব ছিল না। পঞ্চাশ বছর আগে তো নয়ই, এই সাতাশি-অষ্টআশি সালেও ছিল না এত বাড়াবাড়ি। তখনো দেখেছি দু একটা ঝকমকে জামা ভাড়া করলেও বাদবাকী পোশাক শিল্পীরা নিজেদের ঘরের থেকেই নিয়ে নিতেন। বাড়ির মেয়েদের শাড়ী ব্লাউজ সায়া জোড়াজুড়ি করেই, পোশাকের ব্যাপারটা সমাধান করে ফেলা হত। একবার তো দেখেছি মহিষাসুরের ব্যাকপিস হিসাবে একটা বাহারী শাড়ী বসান পাতলা কাঁথা সেপটিপিন দিয়ে পিঠে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে দর্শক সমাজে তো রসগ্রহণের কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু আর্থিক সংস্থানের সুযোগে সেখানে এসে গেল লাল টকটকে রোলেক্সের জরি লাগান ভেলভেট কিংবা নাইলন ডেক্রনের ঝলমলে বেশ ‘গর্জাস’ ধরনের ব্যাকপিস। এসবই যুগের চাহিদা। যুগ কেলকেপাতাড়িকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে সময়ই তা বলবে। তবে কোথাও যে নিয়ে চলেছে তার আর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ খোদ কালী। ধানসিদ্ধ করার হাঁড়ির তলা থেকে ভূষোকালি চেঁছে নিয়ে তেলে গুলে মেখে এলোচুলের যে কালী যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ঙ্করী হয়ে উঠত, সেই কালী হয়ে গিয়েছে শ্যামা। বস্তুতঃ সাধারণ জনসমাজেও এখন রামপ্রসাদী গানের জনপ্রিয়তার সূত্রে ‘শ্যামা’ শব্দটির খুব চল। আর যেকোনও ভাবেই হোক ‘শ্যামা’ মানে লোকে জেনেছে সবুজ। ফলে শ্যামা কালী মানে সবুজ রঙের কালী প্রতিমা। এই সবুজটা কখনো কখনো নীলচে হয়, কখনো একটু কালচে হয়। এই নীলচে সবুজ কালী কেলকেপাতাড়িতেও এসে গেছে।
আধুনিক শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যপ্রভাবে নানা সূত্রে বাস্তবরীতির প্রভাব পড়ছে। যুগপরিবেশ কাজ করছে। ভারতীয় শিল্প চেতনায় যে আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণার বড় ভূমিকা ছিল তা অনেকাংশে ভেঙে যাচ্ছে। নানাভাবে চমক সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এই পটভূমিতেই একদিকে দেখা যাচ্ছে মহাদেব চরিত্রের জন্য জ্যান্ত সাপ ধরে রেখে দেওয়া হচ্ছে। দর্শককে যুগপৎ চমক ও মজা দেওয়া হচ্ছে অন্যদিকে পুজোমণ্ডপের জনপ্রিয় শ্যামাকালীকে কেলকেপাতাড়ির কালী বলে নামানো হচ্ছে। এগুলো কি উন্নতির লক্ষণ? অবশ্যই নয়। কারণ রতনপুরের দলটির মত নামী দলগুলিই কেবল এই পথে চলেছে। কারণ সাধারণ মানুষও এখন চমক ও চাকচিক্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তারা হাততালিও দিচ্ছে। কিন্তু অন্যত্র বহু গ্রামে কালীর সাজে আমরা ঘোর কৃষ্ণবর্ণা কালীকেই দেখছি। এমন কি এই নাচের গোড়ায় যে সঙ সাজার প্রথা, সেই সঙেও কালী সস্তার ভূযো কালিতেই রঞ্জিত হচ্ছে, এখনও। কারণ কালীর সঙ সেজে যে লোকটি ভিক্ষা করতে বের হচ্ছে তার অর্থনৈতিক অবস্থা এমন নয় যে, সে বাজারের পেশাদার মেকআপ ম্যানকে দক্ষিণা দিয়ে ভাড়া করবে। যদি পারত, তাহলে সেও মেকআপ-ম্যানের ‘আর্ট’ এর কজায় বাঁধা পড়ত নির্ঘাৎ। মেকআপম্যান যত রঙ তুলির কারিগরি দানে অভ্যস্ত সে সবই ঐ কালী-র উপর প্রয়োগ করত এবং সে কালীকে ক্রমশই জনপ্রিয়তার দিকে নিয়ে চলবে তার নিজস্ব বৃত্তির তাগিদেই।
যাইহোক আমরা এখনও বীরশিবপুর, কুলগাছি, তুলসীবেড়ে প্রভৃতি জায়গায় ভূষা মাখা কৃষ্ণবর্ণা কালীর যেমন দেখা পাচ্ছি তেমনি ছেড়া চটের বস্তার টুকরো পরিহিত মহাদেবও দেখছি যা সঙের প্রথম আলো। যা চিরন্তন।
কেলকেপাতাড়ি নাচের প্রথম গুণ যদি হয় ইশারার অভিনয়, তো দ্বিতীয় গুণের কথায় বলতে হয় এর আলোক সম্পাতের দিকটি। সমগ্র আয়োজন অনুষ্ঠানের কাজ ডে-লাইট হ্যাজাকের আলোতে সম্পন্ন করা হলেও কেলকেপাতাড়ি অভিনীত হবে মশালের আলোয়। এর দুটো দিক আছে, যার গুরুত্ব অনেক। প্রথমটি হল মশাল নিয়ে মশালধারী নাটকের চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে নড়াচড়া করে আলোটি চরিত্রের উপরে বজায় রাখতে পারছে, যেটা আজকাল থিয়েটারে স্পট লাইটের মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে করা হয়। ডে-লাইট বা হ্যাজাক নিয়ে পঞ্চাশ বছর আগে যেমন এটা সম্ভব ছিল না, আজও টিউব লাইট বা তারে জ্বালানো বড় বাল্ব নিয়ে ছোটাছুটি সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ঐ থিয়েটারের স্পট আনতে হয়, নচেৎ সমগ্র মঞ্চ ক্ষেত্রটি যথেষ্ট আলোয় ভরে দিতে হয়। অত্যাধুনিক এবং অর্থবান আয়োজকেরও এ পর্যন্ত এতটা আগ্রহ হয়নি যে, ঐ এক ঘন্টার অনুষ্ঠানের জন্য ফাকা জায়গায় অত আলো লাগিয়ে রাখবে। তাই রতনপুরের মত দল তাদের আটচালার সুযোগ নিয়ে আটচালার ভিতরে আলো লাগাচ্ছে এবং তা সঙের প্রতিযোগিতা, যাত্রা প্রভৃতি অনেকগুলো কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু সাধারণভাবে কেলকেপাতাড়ির জন্য মশালের আলোই উপযুক্ত, কারণ তার নান্দনিক আবেদন। যা আমি এ আলোচনার প্রথম পর্বেই বর্ণনা করেছি। এপ্রসঙ্গে ছয়ানি গুজরাট গ্রামের কেলকেপাতাড়ির উল্লেখ করতে হয়। আটচালার বাইরে উত্তর-পূর্ব অংশের ফাঁকা জায়গাটা কেলকেপাতাড়ির জন্য নির্দিষ্ট ছিল। পূর্বদিকে বড় পুকুর। ফলে ফাঁকা, কোন গাছপালাও নেই। মুক্ত আকাশ। তারই নিচে কাঁচা তাল সাড়া-র মাথায় কাপড়। জড়িয়ে কেরোসিনে ভিজিয়ে জ্বালানো মশাল একটা অতিরিক্ত মাত্রা পেত। এটা হয়ত রয়ে যাবে ‘স্পট লাইট’ এর যুগেও।
আমরা ১৯৮৮তে কলকাতার ময়দানে আই.টি.এফ গ্রাউণ্ডে যে মাঠে এক সময় বইমেলা হত। ক্রাফটসকাউন্সিল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল আয়োজিত পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যানুসারী নাট্যোৎসবের সময় যখন কেলকেপাতাড়ি উপস্থাপন করেছিলাম, তখনও এই মশাল রেখেছিলাম। ঐ নাট্যোৎসবে প্রচুর বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা ছিল। তা সত্বেও আমরা সবুজ রঙের কাঁচা তাল সাঁড়ার মাথায় কেরোসিনে জ্বালা কয়েকটি মশাল রেখেছিলাম। বলা বাহুল্য যে, এটা শহরের সমাগত বিদগ্ধ নাট্যরসিকদের প্রশংসা লাভ করেছিল। ঐ মঞ্চেই প্রখ্যাত নাট্য ও নৃত্য বিশারদ সুনীল কোঠারী আমার কাছে মত প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, এই নাটকটি সর্বভারতীয় বিস্তার লাভের সম্ভাবনা আছে, কারণ এতে কোনও কথা নেই। মুখের ভাষা এখানে কোনও বাধা হচ্ছে না।
[সেই সময়ে কালিকাপাতাড়ি নিয়ে আমরা যে অভিযান চালিয়েছিলাম তা সম্যকরূপ বুঝতে আগ্রহী পাঠকের জন্য শ্যামল দত্তের একটি রচনা ছয়ানি গুজরাট’ (অক্টোবর, ২০০২) পত্রিকা থেকে পরিশিষ্ট অংশে দেওয়া হল।]
ছবি সায়ন দে’র সৌজন্যে
[তিনটি পর্বে প্রকাশিত হল হাওড়ার লুপ্তপ্রায় লোকনাট্য নিয়ে তপন করের ‘কালিকাপাতাড়ি’। গত দু’দিনে প্রকাশিত হয়েছে প্রথম পর্ব কালিকাপাতাড়ি: হাওড়া জেলার এক নিজস্ব লোক ঐতিহ্য ও দ্বিতীয় পর্ব কালিকাপাতাড়ি—দ্বিতীয় পর্ব: কেলকেপাতাড়ি।]