‘আমি যে রিসকাওয়ালা , দিন কি এমন যাবে , বলি কি ও মাধবী , তুমি কি আমার হবে। আকাশে সূর্য উঠে , পুকুরে পদ্ম ফোটে , হৃদয়ের কুটনো কোনো , অসহ মদনজ্বালা
আমি যে রিসকাওয়ালা।’

না আমার গল্প কোন কাল্পনিক রিসকাওয়ালা কে নিয়ে নয়। জীবনের আয়নায় দেখা এক জলজ্যান্ত মানুষের উপাখ্যান।

সে আজ প্রায় ২৭ বছর আগেকার কথা। লোকটার সঙ্গে ভারী অদ্ভুত ভাবে পরিচয়। আগের রাতে এসে পৌঁছেছি দীঘা। পরের দিন সকালে একটু হাঁটতে বেড়িয়েছি। কিন্তু রাস্তাঘাট সুনসান , জনমানব শূন্য বালুকাবেলা। প্রকৃতি দেবী রুষ্ট-তার সঙ্গে সঙ্গত করছে ডমবুরু বাজিয়ে কালো চোখের ঝিলিক হেনে , অতিশয় ঘন কালো মেঘপুঞ্জ। সমুদ্রের সে কি গর্জন , যেন মহা দিগন্তের অট্টহাসি। কিন্তু না ঘন্টা খানেকের মধ্যেই তিনি আমাদের উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তি দিলেন, আবার যেন খিল খিল করে হেসে উঠলেন। ফিরে চলি হোটেল পানে। রাস্তায় দেখি এক জটলা , বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা কাকে যেন ঢিল ছুড়ছে। কয়েকজন রিকশাওয়ালা ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কি মুশকিল , প্রকৃতি দেবী যদি বা তুষ্ট হলেন-মানব জীবন কেন এত রুষ্ট ! কৌতূহলী হয়ে উঁকি মেরে দেখি একটি শীর্ণকায় , ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ বছর ত্রিশের নাতিদীর্ঘ মানুষকে ঘিরে মজা জমেছে।গুটিকয়েক রিকশাওয়ালার দাঁত বের করে হাসছে , বাচ্চারা সব চোর-চোর বলে খেপাচ্ছে ও ঢিল ছুঁড়ছে । বাচ্চাদের ধমক দিয়ে লোকটিকে ডাকি। কি ব্যাপার? লোকটা প্রথমেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ওঠে। ভারী অস্বস্থি হয় খোলা রাস্তায় নাটক জমছে দেখে।তার পরে চোখ মুছে যা বললো তার সারমর্ম হচ্ছে-ওর নাম দামু তবে সবাই ওকে পাগলা বলে ডাকে , পেশায় রিকশা চালক। ওর মা বিগত কয়েকমাস ধরে শয্যাশায়ী। হাতুড়ে ডাক্তার হাল ছেড়ে দিলে , মা কে নিয়ে গেছিল কলকাতার সরকারি হাসপাতালে। পেটের ক্যান্সার ধরা পড়েছে , জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করে মা কে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ কেনার জন্য কমপক্ষে ত্রিশ হাজার টাকা দরকার ছিল। কোথায় পাবে এত টাকা ,ধার নিয়ে শোধ করবারও ক্ষমতা নেই। কেউ ধার দেবার মতনও নেই। অপারেশন হয়ে যাবার পরে বিনা চিকিৎসায় মা-টা মারা যাবে ? কোন উপায় না দেখে , রিকশা মালিকের বাড়িতে ঢুকেছিলো ক্যাশবাক্স ফাঁকা করবার জন্য। আনাড়ি হাত , কিছু তো হয়নি , উল্টে ধরা পড়ে মার ও জেল। দিন দশেক হল জেল থেকে বেরিয়েছে।ইতিমধ্যে দামুর মা-ও ওকে সাংসারিক বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছে। কেউ ওকে রিক্সা দিতে চায়না , এদিকে অন্য কাজও জানে না। অনেক কষ্টে হাত পা ধরে একজন অন্য মালিকের রিক্সা দুদিন হলো যোগাড় করেছে। কিন্তু বাকি রিকশাওলারা সওয়ারি পেলেই চোর বলে ভড়কে দিচ্ছে। একজন সওয়ারিও আজ দুদিন পায়নি। গত সাতদিন ধরে পরিবার নিয়ে প্রায় নির্জলা উপবাস করে আছে।

লাও , সকাল সকাল এ কি ফ্যাসাদ। সামনের এই পান সুপারি ছাপ দাঁতের মালিক যে গল্পটা বল্লো সেটা কি সত্যি! না মনভোলানো কাহিনী? মন বললো কেন ঝামেলা করছো , সিধে কেটে পর! কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি সামনের এই পাগলা মানুষটার অসহায়তা আমাকে কাটতে দিচ্ছে না।মুখ ফস্কে বলে ফেললাম , ঠিক আছে , এক ঘন্টা পরে সামনের হোটেলে এস। চন্দনেশ্বর , তালসারি যাবো তোমার রিকশায়। বত্রিশ পাটি পানছাপ দাঁত দেখিয়ে সেখানেই প্রায় আভূতি প্রনাম করে আরকি। ঘন্টা খানেকের মধ্যে রিকশা নিয়ে দামু হাজির। চেপে বসলাম ওর রিকশায়। আরে এ যে দেখছি মহা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে ! সমানে বকবক করে চলেছে।

‘বাবু,আমার নাম দামু’।

আগেই বলেছ ।

‘জাতিতে কেওট’।

খুব ভালো কথা।

‘ বাপ-পিতামর কাজ ছিল গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা, আর আমি কিনা রিশকা চালাচ্ছি।’

কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে বাপু রিকশা চালাতে? দয়া করে মুখ বন্ধ করো আর চলো।

অমরাবতী লেকে এসে কিছুক্ষন বিশ্রাম। মানুষের তৈরি লেক , ভীষণ কৃত্রিমতা দোষে দুষ্ট। এবার দামু পড়লো আমার বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে। কখনো গল্প করে, কখনও গুন গুন গান করে। শুনি গাইছে-

‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা।

সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না।

আসবার কালে কি জাত ছিলে , এসে তুমি কি জাত নিলে।

কি জাত হবে যাবার কালে ,সে কথা ভেবে বলোনা।’

ও কেওট এর পো , এ তো মাছুয়ারাদের গান নয় , এতো বাউল গান। তুমি শিখলে কোথা? শুনলাম কম বয়সে ভেক ধরে কিছুদিন কোনো বাউলের চেলাগিরি করেছে বীরভূমে।

‘আর যে গল্পগুলো বলছিলে?’

এবার দামুর মুখ উজ্জ্বল হয় , ‘আমি লিখি স্যার-একটা খাতায় অনেক গল্প ,কবিতা লেখা আছে।’ আরে বাপরে ! বলে কি? একাধারে এত গুন? আজকের অদ্বৈত মল্লবর্মণ।

রিকশা এসে চন্দণেশ্বর শিবমন্দিরে দাঁড়ালো। উড়িষ্যা মন্দির শৈলীর সঙ্গে বাংলার পঞ্চরত্ন শৈলীর মিশ্রনে তৈরি। মন্দিরে থিক থিক করছে ভক্তের দল।আসলে সেদিন উড়িষ্যার পানা বা মেষ সংক্রান্তি ,বাংলার ১লা বৈশাখ। তাই এত ভিড়।সেখান থেকে ফিরে তালসারি।

হঠাৎ করে এক জায়গায় এসে দামু মিনতি করে , ‘স্যার সামনের ১মিনিট কাঁচা রাস্তায় আমার বাড়ি।জেল থেকে বেরিয়ে আপনি প্রথম এত দূরের পেসেনজার , আমার লক্ষ্মী। একটু পায়ের ধূলো দিন। আমিও দুমুঠো খেয়ে নি।’

‘ বল কি গো , এত দূর থেকে রোজ দীঘা যাতায়াত করো ?’

নিমরাজি হয়ে গেলাম ওর বাড়িতে।একটা ছোট খাপড়ার ঘর , সামনে এক চিলতে উঠোন , সেখানেই রান্নাবান্না। তিনটি অপুষ্ট ছেলেমেয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব তো ঠিকই আছে , কিন্তু বাচ্চাগুলোর মুখে এ কি ভাষা? বাংলা তো নয় , উড়িয়া ও নয়। হ্যাঁ এবার ফর্মুুলা মিললো।মোটাসোটা , কাজলপরা ,ডান নাকে নথ ,পায়ে পয়জার , মাথায় ঘোমটা কিন্তু চোখে বিদ্যুৎ। দামুুুর থেকে অনেক সুুুন্দর , মুখটি বেশ ঢলঢলে যদিও বাতাসে মিশে আছে বিড়ির গন্ধ। সেটা বাদ দিলে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ পাগলা দামুর পাশে তেলেগু সুন্দরীকে মেলানো মুস্কিল। মহব্বতের এ কি খেলা!

সামনের খাটিয়াতে বসে আছি , দামু একটা হলুদ হয়ে যাওয়া খাতা নিয়ে এল , এর মধ্যে ওর অনেক গল্প,কবিতা আছে। গিন্নি সেই খাতাটা নিয়ে নিল , বলল যতদিন আছে পড়বে ,যাবার সময় ফেরত দিয়ে যাবে। রিকসা চড়ে দামুকে বলি-‘তোমার নাম তো কেষ্টা হওয়া উচিত ছিল।তেলেগু বৌ পেলে কোথায় ?’ মিটমিট হেসে একেবারে বাম্পার ছুঁড়ল , গান ধরলো-
“সব লোকে কয় , লালন কি জাত এ সংসারে।
আমি কই ,জেতের কি রূপ ,দেখলাম না নজরে।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান , নারী লোকের কি হয় বিধান।
বামন চিনি পৈতার প্রমাণ , বামনী চিনি কি ধরে?”

ঘোর তত্ত্বকথা। বাঙালি ,তেলেগু এসব শব্দের উপর যেন ঝামা ঘষে দিলো।’প্রশ্ন করি , পড়াশুনো কদ্দুর?’

উত্তর এলো-‘কেলাস এইট’।

এরপর তালসারির শান্ত সমুদ্র , বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা , আকাশে আসমানী চাদর , লাল কাঁকড়ার লুকোচুরি খেলা। মাঝে মাঝে মাছের আঁশটে গন্ধ। তালসারিতেই দামু ওর শ্বশুর বাড়ি দেখায়। বেশ বড় বাড়ি,শালা মাছের আড়ৎদার। তবে শ্বশুর বাড়িতে দামুর প্রবেশ নিষেধ। মহাপ্রতাপশালী একমাত্র শালার সঙ্গে আদায় কাঁচকলায় সম্বন্ধ।

হোটেলে ফিরে এসে দামুর খাতাটা নিয়ে বসলাম।মাটির গন্ধ মাখা অত্যন্ত সহজ , সরল ভাষায় লেখা। আশ্চর্য-গল্পের বস্তু কিন্তু সরল নয়। ফ্রয়েড থেকে মার্ক্স , সবাই যেন মিলেমিশে আছে। ছেঁড়া জামার নিচে এক বুক খিদে নিয়ে এই সব লেখা আসে কি করে?

শেষদিন ওকে কিছু বকশিস দিয়ে ওর খাতাটা ফেরত দিলাম। মনে হলো যেন ওর চোখের কোনা চিকচিক করছে।
পরদিন সকালে হোটেল reception থেকে ফোন এলো , দুটি ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কি বিপদ , এক্ষুনি বেরোতে হবে। নিচে নেমে দেখি দুটি অচেনা ছেলেকে দামুর বৌ পাঠিয়েছে। দামুকে গতকাল পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

ওদের কাছে যা জানা গেল-গতকাল বিকেলে দামু মাল খেয়ে চূর হয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে অতিশয় গালিগালাজ ও হাতাহাতি করে এসেছিল। একটা দা নিয়ে নাকি কেটে ফেলার হুমকি দিয়েছিল সম্বন্ধীকে। এবার ওর মহাজন শালাই পুলিশ নিয়ে এসে বমাল শুদ্ধ চোর ধরে নিয়ে গেছে।দামুর বৌ এর কথা অনুসারে পুরো ঘটনা ওর দাদার সাজানো কীর্তি।

বেজার মুখে ছেলে দুটির সঙ্গে থানায় গেলাম। কি আর বলব , না জানি দামুকে, না জানি ওর শালাবাবুকে। তবুও পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করে নিজের কার্ড দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম , দামুর বউ কেন অকারণে মিথ্যা কথা বলবে ? উনি কথা দিলেন , নিরপেক্ষ তদন্ত হবে।আমিও মনের ভার কিঞ্চিৎ লাঘব করে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসি।

মাস তিনেক পরে হটাৎ করে থানা আধিকারিকের ফোন আসে। দামুর অবর্তমানে ওর বৌ , ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায় , এবং সেখানেই আছে। দামুর মধ্যে মস্তিস্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দেওয়ায় ওকে সরকারি মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে। সেই হাসপাতালের একজন ডাক্তারের সঙ্গে ভালোই পরিচয় ছিল। একবার ভাবলাম ওঁকে ফোন করি , কিন্তু করব করব করে করতে অনেক দেরি হয়ে গেল। শেষ অবধি আরো মাসখানেক পরে যখন ওঁকে ফোন করলাম তখন জানতে পারলাম , দিন পাঁচেক আগে দামুর বউ নাকি সাংসারিক কারণে বাপের বাড়িতেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। পই পই করে খবর দেবার বারণ সত্বেও , সম্ভবত হাসপাতালের কেউ একজন দামুকে সেই খবর জানিয়ে দেয়। গতকাল হাসপাতালের শৌচালয়ে পরণের কাপড় জড়িয়ে ও ঝুলে পড়েছে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন
Avatar photo

By তিলক পুরকায়স্থ

পেশায় রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্ত চিকিৎসক। নেশায় ক্ষেত্রগবেষক ও চিত্রগ্রাহক। পায়ের তলায় সর্ষে।

Leave a Reply